ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রসারের ইতিহাস (পর্ব-২০)

 আগের পর্ব এখানেপর্ব এখানে

উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে কেউ ইসলাম গ্রহন করেনি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির দেশ বাংলাদেশ, হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির লীলাভূমি বাংলাদেশ। এ দেশ হিন্দু মুসলমানের নয়। এ দেশ বাঙালীদের দেশ।
মুসলিম পণ্ডিতদের ভাষ্যইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম, শান্তির ধর্ম এবং একমাত্র বেহেস্ত লাবের অধিকারী।
ভারতবর্ষের সাধারণ হিন্দুরা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে– এই হল বেশ কিছু সংখ্যক আধুনিক পণ্ডিত ও রাজনীতিকদের গবেষণা।
ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনদিন সম্প্রীতি ছিল না। ইতিহাস ঘেটে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, শুধু বাঙালী হিন্দু মুসলমানই নয়, পৃথিবীর কীন সম্প্রদায়ের সঙ্গেই মুসলমানদের সম্প্রতি ছিল না এবং এখনো নেই। সারা পৃথিবীতে জাতিগত সন্ত্রাসের প্রায় সবগুলিই মুসলমান সম্প্রদায় কর্ত্ৃক পরিচালিত। এর কারণ অবশ্য ইসলাম ধর্ম। ইসলাম কাউকে সহ্য করে না। পরমত সহিষ্ণুতা ইসলামের অভিধানে নেই। এটা ইসলামের জন্মগত চরিত্র। একজন হিন্দু যখন প্রার্থন করছেন- সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ হোক, মঙ্গল হোক, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ভয়শূন্য হোক, নিরোগ ও শান্তি লাভ করুক; তখন একজন মুসলমান প্রার্থনা করছে, শুধু মুসলিম উম্মাহর (জাতির) উপর শান্তি বর্ষিত হোক, অন্যান্য জাতি ধ্বংস হোক।
যেখানে একজন মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন লোক মনে করছেন হত্যা, লুণ্ঠন, বিধর্মী অত্যাচার অন্যায়, সেখানে একজন মুসলমানের কাছে ঐ সব অপকর্মগুলি পরম ধরম ও অবশ্য পালনীয় কর্ম। কাফের হত্যা, তাদের সম্পত্তি লুট করা ধর্ম, তাদের বউ, মেয়ে দখল করে ভোগ করা ধর্ম। আক্রমন, আগ্রাসন, অমুসলিম হত্যা করে তাদের সমত্তি লুট করা এবং নারী ও শিশু অপহরন আজকের সভ্যতায় বর্বরতা ব্লে বিবেচিত হলেও মুসলমানের কাছে এই অপকর্মগুলি পরম ধর্ম । বলা বাহুল্য এই সমস্ত উপায়েই পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ইতিহাস না পড়া কিছু স্বঘোষিত পন্ডিত প্রচার করেছেন, ভারত উপ-মহাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির কারন হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথা এবং উচ্চবর্ণ নিন্ম বর্ণ বিরোধ। এর ফলে নিন্মবর্ণের লোকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কথাটি যে সর্বাংশে মিথ্যা তা ইতিহাস পাঠক মাত্রই জানেন।
প্রকৃত তথ্য হল — আক্রমণ, আগ্রাসন, লুণ্ঠন, বন্দী, জিম্মি, জিজিয়া এবং অন্যান্য কৌশলে এদেরকে ইসলামে দীক্ষিত হতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু তারা আবার স্বধর্মে ফিরে না আসার কারণ দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিক মুসলিম শাসন।
৬৩২ খৃষ্টাব্দে হজরত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর মদিনার লোকেরা স্বধর্মে ফেরত যাচ্ছিলেন, কিন্তু হজরত আবু বকর কঠোর নীতি অবলম্বন করে তাদেরকে ইসলামে থাকতে বাধ্য করে।
ঐতিহাসিক ম্যূর বলেন- “সমগ্র উপদ্বীপের লোক স্বধর্মে ফেরত যাচ্ছিলেন” (এম এ ছালাম; ইসলামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৯)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু স্বল্পকালীন যুদ্ধ শেষে তারা আবার স্বধর্মে ফিরে এসেছিলেন।

১৯৪৬ সালে নোয়াখলীতে অনেক হিন্দু মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু রায়ট শেষ হলে তারা আবার স্বধর্মে ফেরত আসেন। কিন্তু ৬০০ থেকে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত যারা মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা আর স্বধর্মে ফিরে আসার সুযোগ পাননি। কারন সহস্র বছর তাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছিল রেশমী সুতায় বাধা তলোয়ার। আজ তাদের সন্তানগন ভুলেই গেছে তাদের পূর্ব পুরুষগণ বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, মনের তাগিদে হয়নি

এরপর… কাফের-মুসরিক-মুনাফেক-জেহাদ-গনিমতের মাল

ব্রহ্ম কমল

উদ্ভিদের প্রজাতি

Brahma Kamal.jpg

ব্রহ্ম কমল এক ধরনের সপুষ্পক উদ্ভিদ যাদের মূল আবাস হিমালয় পার্বত্য এলাকা, ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশ, মায়ানমারের উত্তরাংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীন। এটি হিমালয়ের ৪৫০০ মি. উর্দ্ধে দেখা যায়[২]। এটি উত্তরখন্ডের রাষ্ট্রীয় ফুল[৩]। এটি ০.৩ মি. (১ ফুট) দৈর্ঘের হয়। এর অন্য নামগুলো হলো: ব্রহ্মকমল, কন, কাপ্ফু।ব্রহ্ম কমল
Saussurea obvallataবৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসজগৎ:Plantae(শ্রেণীবিহীন):Angiosperms(শ্রেণীবিহীন):Eudicots(শ্রেণীবিহীন):Asteridsবর্গ:Asteralesপরিবার:Asteraceaeগোত্র:Cynareaeগণ:Saussureaপ্রজাতি:S. obvallataদ্বিপদী নামSaussurea obvallata
(DC.Edgew.[১]

ভেষজ হিসেবে ব্যবহারসম্পাদনা

তিব্বতে এই উদ্ভিদ ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত্ হয়ে থাকে, যা সেখানে “সা-দু-গোহ-ঘুহ” (তিব্বতীয় ভাষায়: ཤཟའ བདྭད མཤ དཤྭ ) নামে পরিচিত। এটি তিতা স্বাদযুক্ত। সম্পূর্ণ গাছটিই ব্যবহারযোগ্য। এই উদ্ভিদটি বিলুপ্ত-প্রায় হয়ে যাচ্ছে কারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনে এটি কেটে নিয়ে ধ্বংস করছে। এটি হিমালয়ের প্রার্বত্য এলাকায় পাওয়া যায়। এটি মুত্র-সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত্ হয়[৪]

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে খোঁজ মিলল ১৩০০ বছরের পুরনো বিষ্ণু মন্দিরের

ইসলামাবাদ: পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমে সোয়াত জেলার একটি পর্বতে খোঁজ মিলল ১,৩০০ বছর আগে নির্মিত একটি হিন্দু মন্দিরের। পাকিস্তানি ও ইতালিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা এই মন্দিরটি আবিষ্কার করেছেন।

বৃহস্পতিবার এই মন্দির খোঁজের কথা জানিয়ে খাইবার পাখতুনখওয়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফজলে খালিক জানিয়েছেন, আবিষ্কৃত মন্দিরটি ভগবান বিষ্ণুর মন্দির। বারিকোট ঘুন্দাই খননের সময় এই খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, ১৩০০ বছর আগে হিন্দু শাহী আমলে হিন্দুরা এই মন্দির তৈরি করেছিল। হিন্দু শাহী হল একটি হিন্দু রাজবংশের সময়কাল যারা কিনা কাবুল উপত্যকা, পাকিস্তান , আফগানিস্তান এবং বর্তমান উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করেছিল। মনে করা হচ্ছে, তাঁদের আমলেই এই বিষ্ণু মন্দির তৈরি।

খননকালে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মন্দিরের কাছাকাছি এলাকায় সেনানিবাস এবং প্রহরীদের থাকার জায়গারও হদিশ পায়। এথেকে সহজেই অনুমেয় যে একসময় এই মন্দির ছিল কড়া পাহারার অন্তর্ভুক্ত।

বিশেষজ্ঞরা মন্দিরের কাছে একটি পুকুরও পান, যা থেকে মনে করা যায় সেটি পূজা করার আগে স্নানের জন্য অথবা নানান ভক্তিমূলক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা হত।

ইতালিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক মিশনের প্রধান ডাঃ লুকা বলে৪ছেন এটি গান্ধারা সভ্যতার মন্দির। যা কিনা সোয়াত জেলায় প্রথমবারের জন্য আবিষ্কৃত হল। শুধু হিন্দুধর্মের না, বৌদ্ধধর্মের বেশ কয়েকটি উপাসনাস্থল সোয়াত জেলায়ও অবস্থিত।

সর্বধর্ম সমন্বয়’, মানবিক ধর্ম কখনও অমানবিকদের সাথে সমন্বয় করতে পারে না

কৃত্তিবাস ওঝা

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে প্রতিটি হিন্দু শিশুর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ কিংবা ‘যত মত তত পথ’। ফলে প্রতিটি হিন্দুর মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, প্রতিটি ধর্মই সমান। এজন্য হিন্দুরা যখন দেখে, তার ধর্মের লোকেরা প্রলোভন ও  প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছে, তখন সে প্রতিবাদ করেনা; উল্টো সে ধর্মনিরপেক্ষতার দামামা বাজাতে শুরু করে দেয়। এভাবে ধর্মান্তরিত হতে হতে যে এলাকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে, তারা টের পায় – কত ধানে কত চাল, কত গমে কত আটা।

যেমন কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দুরা বুঝেছে, উত্তর পূর্ব ভারতের পাঁচ রাজ্যের সংখ্যালঘু হিন্দুরা বুঝেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদাহ,বসিরহাট,ডায়মন্ড হারবার; এমনকি কলকাতা শহরের পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার,খিদিরপুর,মেটিয়াব্রুজ  প্রভৃতি অঞ্চলের সংখ্যালঘু হিন্দুরা বুঝতে পেরেছে ― অন্য ধর্মের লোকেরা ভুলেও বলে না যে, সকল ধর্ম সমান। অন্য ধর্মের লোকেরা বলে, হিন্দুরা একেশ্বর কর্তৃক অভিশপ্ত; হিন্দুরা স্বর্গে গিয়ে ৭২ জন অনন্ত যৌবনা নারী সম্ভোগ করতে পারবেনা।

সমকামের জন্য নাদুসনুদুস বালক পাবেনা, মদিরা পান করতে পারবে না। হিন্দু হত্যা করলে একেশ্বর খুশি হয় ; হিন্দু নারী ধর্ষণ করে – তার গর্ভে স্বজাতি জন্ম দিতে পারলে, একেশ্বর আরো অনেক বেশি খুশি হয় ; হিন্দুর বিষয়-সম্পত্তি, সহায়-সম্বল কেড়ে নিয়ে ভিটেছাড়া করতে পারলে, ইহকালে যেমন সুখ-সমৃদ্ধি আসে এবং পরকালেও তেমনি স্বর্গে গমনের রাস্তা সুগম হয়ে যায়।

অন্য ধর্মীদের, যে কথা-সেই কাজ। তারা কাশ্মীর থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মেরে-কেটে, লুণ্ঠন-ধর্ষণ করে তাড়িয়েছে;  একই প্রক্রিয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্য হয়ে উঠেছে হিন্দু বধ্যভূমি; মিনি পাকিস্তান ঘোষিত পশ্চিমবঙ্গের বিধর্মী সংখ‍্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে চলছে মধ্যযুগীয় কায়দায় হিন্দু নির্যাতন। হিন্দুদের গণপ্রতিরোধের শিকার হয়ে, যদি ভিন্নধর্মের  কোন ছিনতাইকারী বা ডাকাতও নিহত হয়,অমনি সেক্যুলার নামধারী উগ্র হিন্দু-বিদ্বেষী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারের বিষবাষ্পে বিশ্ব-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

অথচ ভিন্নধর্মীদের একের পর এক পরিকল্পিত সন্ত্রাসী আক্রমণে, প্রতিবছর হাজার হাজার নীরিহ হিন্দু নিহত হচ্ছে – তখন ঐ বর্বরতার বিরুদ্ধে কোন সেক্যুলার রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবী টু-শব্দটি পর্যন্ত করে না; বরং অপরাধীদের রক্ষা করতে সেক্যুলার বেজন্মাগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বলে, সন্ত্রাসীদের কোন জাত নেই, ‘যত মত তত পথ’ ও ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ – এই আমাদের চিরায়ত শিক্ষা।

অল্প কিছুদিন আগে, মহারাষ্ট্রে বিধর্মী সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় দু’জন হিন্দু সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ভিডিও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সত্বেও, কোন অমর্ত্য সেন মুখ খোলেনি,কোন অরুন্ধতী রায় প্রতিবাদ করেনি; পশ্চিমবঙ্গের কোন সেক‍্যুলার বুদ্ধিজীবী কাপড় খুলে দেখাতে চায়নি। উল্টো ইতালীয় বংশোদ্ভূত খ্রিষ্টধর্মালম্বী সোনিয়া গান্ধী, তার স্বজাতি খ্রিষ্টান খুনিদের অপরাধ আড়াল করতে – সংবাদ সম্মেলন ডেকে এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন।

সোনিয়া গান্ধীকে পাশ্চাত্য থেকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ভারতে পাঠানো হয়েছে। অতীতে ‘যত মত তত পথ’ ও ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’  নামক ভাইরাস দু’টিও পাশ্চাত্য থেকে অত্যন্ত কূটকৌশলে হিন্দু জাতির মধ্যে সংক্রামিত করা হয়েছে। এই ভাইরাস দুটিকে লুফে নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা – যারা ভারত ভূমি থেকে হিন্দুজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষাক্ত ছোবলে, স্বাধীনতার পর ভারতের হিন্দু জনসংখ্যা হার ৮৫ শতাংশ থেকে ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আরব সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে সুজলা-সুফলা ভারত ভূমি,রক্তস্নাত হয়ে ক্রমাগত খণ্ড খণ্ড মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

সুতরাং কোন হিন্দুর উচিত নয়, তার সন্তানকে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ কিংবা ‘যত মত তত পথ’ শিক্ষা দেওয়া। প্রতিটি হিন্দু শিশুর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, সনাতন ধর্ম-ই শ্রেষ্ঠ মানবিক ধর্ম। মানবিক ধর্ম কখনও খুনি-অমানবিক ধর্মের সাথে সমন্বয় করতে পারে না। মানবতার পথ-ই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পথ; কাজেই মানবিক হিন্দুর পথ আর রক্ত পিপাসু মরু-ডাকাতদের পথ, কখনোই এক হতে পারেনা।কৃত্তিবাস ওঝা

🌺অথ: দশমহাবিদ্যা কথা🌺 (পর্ব-১)

🌺অথ: দশমহাবিদ্যা কথা🌺 (পর্ব-১)

দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী হলেন কালী। মহাভাগবতের মতে মহাকালীই হচ্ছেন মুখ্য (প্রধান) এবং তাঁর ‘উগ্র ও সৌম্য দুই রূপের অন্তবর্তী অনেক রূপ ধারণকারিণী হল দশ মহাবিদ্যা। বিদ্যাপতি ভগবান মহাদেবের শক্তি এই দশমহাবিদ্যা অনন্ত সিদ্ধি প্রদানকারিণী। দার্শনিক দিক থেকেও কালতত্ত্বের প্রাধান্যই সবার উপরে।এইজন্যই মহাকালী বা কালীই সমস্ত বিদ্যার আদি অর্থাৎ তার বিদ্যাময় বিভূতি সকলই মহাবিদ্যা । মনে হয় মহাকালের প্রিয়তমা কালীই নিজের দক্ষিণ ও বাম রূপসমূহে দশমহাবিদ্যা নামে বিখ্যাত। বৃহন্নীল তন্ত্রেবলা আছে যে রক্ত ও কৃষ্ণভেদে কালীই দুই রূপে অধিষ্ঠিতা। কৃষ্ণার নাম ‘দক্ষিণা’ এবং রক্তবর্ণায় নাম ‘সুন্দরী’।
কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে, যে একদা হিমালয়ে অবস্থিত মতঙ্গ মুনির আশ্রমে গিয়ে দেবতারা মহামায়ার স্তুতি করেন। স্তুতিতে প্রসন্না হয়ে মতঙ্গের স্ত্রীর রূপ ধারণ করে ভগবতী দেবতাদের দর্শন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন—তােমরা কার স্তব করছ? সেই সময় দেবীর শরীর থেকে কালাে পাহাড়ের মত বর্ণযুক্তা আনাে এক দিব্য নারী প্রকট হন। সেই মহাতেজস্বিনী নিজেই দেবতাদের তরফ থেকে প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে এরা আমারই স্তব করছে। সেই নারী কাজলের মত কৃষ্ণবর্ণা ছিলেন, সেইজন্য তার নাম হয় ‘কালী’।
শ্রীশ্রীচণ্ডী , অনুসারে একদা শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচারে ক্লিষ্ট হয়ে দেবতারা হিমালয়ে। ‘দেবীসূক্ত’ দিয়ে দেবীর বন্দনা করেন, তখন গৌরীর দেহ থেকে কৌশিকী আবির্ভূতা হন। কৌশিকী গৌরীদেহ থেকে আলাদা হওয়ামাত্রই অম্বা পার্বতীর স্বরূপ কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যায় এবং তখন তিনি ‘কালী’ নামে বিখ্যাত হন। কালী নীলবর্ণা হওয়ায় তিনি তারা নামেও পরিচিত। নারদ-পঞ্চরাত্রের মতে একদা কালীর মনে হল যে
তিনি আবার গৌরী হবেন। এই চিন্তা করে তিনি অন্তর্ধান করেন। মহাদেব নারদের কাছে কালীর সন্ধান জিজ্ঞাসা করেন। নারদ সুমেরু পর্বতের উত্তরে দেবীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতির সংবাদ দেন। শিবের অনুরােধে নারদ সেখানে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেবীর কাছে শিবের সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব শুনে দেবী অত্যন্ত কুপিতা হন এবং তার দেহ থেকে এক অন্য ষােড়শী বিগ্রহ প্রকট হন এবং সেই দেহ থেকে এক ছায়া বিগ্রহ ত্রিপুরেশ্বরী আর্বিভূতা হন।
কালীর পূজাপদ্ধতিতে সম্প্রদায়গত পার্থক্য আছে। সাধারণতঃ কালীর দুটি রূপের উপাসনার পদ্ধতি
প্রচলিত আছে। ভববন্ধন মােচনের উদ্দেশ্যে কালীর উপাসনাই সর্বোৎকৃষ্ট বলা হয়। শক্তিসাধনায় দুই পীঠের মধ্যে শ্যামপীঠেই কালীর উপাসনা করা উচিত। ভক্তিমার্গে তাে যে কোনও রূপেই সেই মহামায়ার উপাসনা ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে তার উপাসনা বীরভাবে করা হয়। সাধনার ফলে অহংবােধ, মমত্ববুদ্ধি ও ভেদাভেদজ্ঞান শেষ হয়ে যখন সাধকের পূর্ণ শিশুভাবের জাগরণ হয় তখন কালীর শ্রীবিগ্রহ
সাধকের সামনে প্রকট হয়। সেইসময় ভগবতী কালীর রূপ অবর্ণনীয়। মূর্তিতে কালীপূজার প্রবর্তন ও জনপ্রিয়তা অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের। দক্ষিণাকালীর যে মূর্তির পূজা আজ সর্বাধিক প্রচলিত, কিংবদন্তি এই যে, নবদ্বীপের প্রখ্যাত তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম তাঁর কল্পনা করেন। ইনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক বিখ্যাত ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের প্রণেতা। আদুলভাবে বলতেন: ‘মা একটি রূপে তুমি আমার কাছে প্রকাশিত হও। এমন একটি রূপ, যে রূপে তুমি সকলের কাছে পূজা পাবে।’ এক মহানিশায় মা প্রসন্না হয়ে বললেন: ‘বাবা, তাই হবে। আমার একটি রূপ তুমি জগতে প্রচার করবে। আজ রাত শেষে ভোর হলে প্রথম যে নারীমূর্তি দেখবে, সেই ভঙ্গিমায় মূর্তি কল্পনা করে তুমি আমার পূজা করবে।’ পরদিন ভোর হতেই কৃষ্ণানন্দ বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। ভোরের অল্প আলোয়- এক স্বল্পবাস কৃষ্ণকায় তরুণী বধূ দেওয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছিলেন। কৃষ্ণানন্দ না জেনে হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হতেই সেই নারী লজ্জায় জিব কাটলেন। কৃষ্ণানন্দ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, তাঁর আরাধ্যা দেবীমূর্তি কেমন হবে। সেই আদলে মূর্তি গড়ে তিনিই প্রথম মৃন্ময়ী মূর্তিতে কালী পূজা করেন। তার আগে তাম্রপাতে মা কালীর ‘যন্ত্র’ এঁকে বা খোদাই করে মায়ের পূজা হত। এরপর কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই কালীপূজাকে ব্যাপক ও জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্য ছিলেন। তান্ত্রিকমতে যদিও কালীর উপাসনা দীক্ষাগম্য (অর্থাৎ কেবল দীক্ষিতেরই অধিকার), তবুও অনন্য শরণাগতি দ্বারা তাঁর কৃপা যে কেউই লাভ করতে পারে। মূর্তি, মন্ত্র অথবা গুরু নির্দেশিত যে কোনও আধারে ভক্তিভাবে মন্ত্রজপ, পূজা, হােম এবং পুরশ্চরন দ্বারা ভগবতী কালী প্রসন্না হন। তার প্রসাদে সহজেই সাধকের অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ হয়।✍

(চলবে)

শক্তি পীঠ

#শক্তিপীঠ
………………
বহুদিন ধরে ইচ্ছা শক্তিপীঠ নিয়ে
লিখবো। বোধ হয় এর আগে
অনেক পেজে/ফেইসবুকে এই শক্তিপীঠ
নিয়ে লেখাও হয়েছে তার পরে ও মা কালীর কৃপায় এই লিখবার
সুযোগ হল।শক্তিপীঠ সৃষ্টির কথা আপনারা
সকলেই জানেন। দক্ষযজ্ঞে মা
সতী দেবী দেহ ত্যাগের পর ভগবান
শিব নটরাজ তাণ্ডব মূর্তি ধারন
করে দেবীর দেহ স্কন্ধে নিয়ে
প্রলয় নৃত্য আরম্ভ করেন।
ত্রিলোককে অকালে ধ্বংসের
হাত থেকে বাঁচাতে ভগবান বিষ্ণু
স্বীয় সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর
দেহ খন্ড খন্ড করেন, এরপর
ভগবান শিব শান্ত হলেন । দেবীর
খন্ড গুলো যেখানে যেখানে
পড়েছিল- সেখানে একটি করে
দেবী পীঠ সৃষ্টি হয়। ভগবান শিব
সেখানে ভৈরব রূপে বিরাজ করতে
লাগলেন। শক্তিপীঠ নিয়ে
লেখবো, আপনাদের কাছে কিছু
কথা তাঁর আগে জানিয়ে রাখি।
১) শক্তিপীঠ ৫১,৫২,১০৮ এই
নিয়ে পুরান শাস্ত্র ও তন্ত্র
শাস্ত্রে মতভেদ আছে। আমরা
পুরান মত মেনে ৫১ পীঠের কথাই
লেখবো। আপনাদের জানিয়ে রাখি
এখনও কয়েকটি শক্তিপীঠ
আবিস্কৃত হয় নি ।
২) প্রাচীন অনেক দেবী মন্দির কে
শক্তিপীঠ নাম দেওয়া হয় ।
যেগুলো আদৌ শক্তিপীঠ না।
এক্ষেত্রে কাশীর পণ্ডিত গন
যেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছেন,
আমরা সেইগুলিই ধরবো ।
৩) সব শক্তিপীঠের ছবি পাওয়া
যায় না ইন্টারনেটে। কারন
নিরাপত্তার জন্য কিছু মন্দিরে
ফটো তোলা বারন, সেক্ষেত্রে
আমরা অন্য কোনো দেবীর ছবি
আপলোড দেবো। আপানদের
কাছে সেই পীঠ সংক্রান্ত ছবি
থাকলে আপনারা তা কমেন্টে
আপলোড করবেন ।
৪) শক্তিপীঠের পূজো তন্ত্র
মতে হয় । সেক্ষেত্রে বলির
প্রসঙ্গ আসবেই। আপনাদের
কাছে অনুরোধ বলি সংক্রান্ত
বিষয় নিয়ে কোন রূপ বিতর্ক
করবেন না ।৪) কোন শক্তিপীঠের অস্তিত্ব
পাওয়া যায় না। আবার কিছু পীঠ নিয়ে সংশয় আছে।
যেমন জয়ন্তী পীঠ , ভ্রামরী পীঠ এগুলোর
একাধিক মন্দির আছে । এই
গুলো নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন
না। কাশীর পণ্ডিত গন যেই
পীঠকে স্বীকৃতি দিয়েছেন- আমরা
সেটাকেই চূড়ান্ত ভাবে ধরবো ।
৫) প্রতি শক্তিপীঠ লেখবার আগে
নাম্বার দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন
১,২,৩,৪,৫ এই ভাবে । আপনারা
নাম্বার অনুসারে পর পর পড়বেন ।
নাহলে বুঝতে পারবেন না।
আশা করছি আপনারা আমার
সহায় হবেন মা সকলের মঙ্গল করুন। আজকে
এখানেই সমাপ্ত করি। মায়ের ইচ্ছাতে আগামী পর্ব
থেকে শক্তিপীঠ সংক্রান্ত লেখা শুরু করবো

সীমান্তরেখা: বাংলা ভাগের বেদনার আখ্যান

পেন্সিলের খসখস শব্দে বহু বছরের পুরনো মানচিত্রটা ধর্মের ভিত্তিতে কেটে ভাগ করে দিলেন সিরিল র‍্যাডক্লিফ। পেশায় তিনি ছিলেন দক্ষ ব্রিটিশ আইনজীবী, কিন্তু মানচিত্র নিয়ে সামান্যতম জ্ঞান ছিল না তার। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় নিয়ে হিন্দু- মুসলমানের ভিত্তিতে মানচিত্রজুড়ে র‍্যাডক্লিফ এঁকে দিলেন ‘সীমান্তরেখা’। এরপর নিজের সব নোট পুড়িয়ে তিনি ফিরে গেলেন ব্রিটেনে, পুরস্কার হিসেবে পেলেন ‘নাইট’ উপাধি।

যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি নিজে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ তখনও স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ উদযাপনে গভীরভাবে মত্ত। হবেও না বা কেন! এ যে প্রায় দু’শো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মুক্তি।

কিন্তু স্বাধীনতা কি সবার জন্য স্বস্তি হয়ে এল? অনেক মানুষ ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল, যে দেশে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, যেখানের মাটি ও বাতাসে তার পরিপুষ্টি, সে দেশ আর তার নিজের নেই। তাকে যেতে হবে অন্য কোন দেশে। ক’দিনের মাঝেই মানবধর্মের ঊর্ধ্বে জয়লাভ করল সাম্প্রদায়িক ধর্ম। ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ধর্মের পরিচয়- হিন্দু, না কি মুসলমান? একজনের রক্তে রঙিন হলো আরেকজনের হাত। ভিটেমাটি সব ছেড়ে একদেশের মানুষ অন্য দেশে গিয়ে হলো ‘উদ্বাস্তু’, ‘বাস্তুহারা’। পরবর্তীতে ভয়াবহ রকমের মানবেতর জীবনের মধ্য দিয়ে যাওয়া সে সব মানুষের কাছে ‘দেশভাগ’ একটি দুঃস্বপ্নের নাম।

১৯৪৭ থেকে ২০১৭, দেশভাগের সত্তর বছর পূর্তিতে ‘সীমান্তরেখা’ নামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। ক্রাউড ফান্ডিং বা গণঅর্থায়নে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রে মূলত সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব হিন্দু পরিবার ভারতে গিয়েছিলেন, ভারত থেকে যেসব মুসলমান পরিবার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) এসেছিলেন এবং বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসকারী মানুষদের জীবনে দেশভাগের প্রভাব ফুটে উঠেছে।মূলত এসব বাস্তুচ্যূত মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রামাণ্যচিত্রটিকে এগিয়ে নিয়েছেন, মানুষের গল্পের মধ্য দিয়ে ফিরে দেখতে চেয়েছেন ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে। তৎকালীন নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে দেশভাগ যে ভয়াবহ বেদনার জন্ম দিয়েছে, বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে সেই মর্মন্তুদ বেদনার প্রকৃত রূপটিকেই তানভীর মোকাম্মেল পুনঃআবিষ্কার করতে চেয়েছেন গবেষণাধর্মী এই প্রামাণ্যচিত্রে।

যাত্রা শুরু হয় অপরাজিতা ঘোষাল ও অঞ্জলি চক্রবর্তী নাম্নী দু’জন প্রবীণ মহিলাকে নিয়ে, যাদের শৈশব কেটেছে এ দেশের মাটিতে। এরপর দেশভাগের সময় বাধ্য হয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভারতে। দীর্ঘ ৭০ বছর পর দেশের মাটিতে ফিরে তারা দেখতে পান, তাদের জায়গায় এখন বাস করছে অন্য মানুষেরা, নিজেদের বাড়িঘর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবুও শৈশবের স্মৃতি হাতড়িয়ে তারা বলতে থাকেন, “ঘরটা ছিল এখানে। বেলগাছ আর আমগাছটা কই গেল?” হারানো সময়ের এই আকুল রোমন্থন শুরুতেই আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। যে গভীর বেদনা তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন, তা তাদের থেকে সংক্রমিত হতে শুরু করে দর্শকের মাঝে। বাংলাভাগ অনিবার্য ছিল কি না, কোনভাবে কি ঠেকানো যেত না, এসব প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে তানভীর মোকাম্মেল আমাদেরকে নিয়ে যান ইতিহাসের পাতায়। দেখান কীভাবে একটি রাজনৈতিক সিন্ধান্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

বাংলা ভাগের ফলে ভারত থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় আটান্ন লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে দেশান্তরী হন। ফলে এই দেশান্তরী হিন্দুদের জীবনে বাংলাভাগ কীভাবে প্রভাব ফেলল, তা এই প্রামাণ্যচিত্রের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। তৎকালীন পূর্ববাংলায় যাদের ঘরবাড়ি ছিল, ফলের বাগান- পুকুর ছিল, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছিল, বাধ্য হয়ে ভারতে যেয়ে তাদের পরিচয় হয়েছে উদ্বাস্তু। জায়গা হয়েছে রেলের পাশের বস্তিতে, বাস্তুহারা কলোনিতে, উদ্বাস্তু শিবিরে। নিম্নমানের জীবন ও অভাবের সাথে যুঝতে যুঝতে তাদের ‘মনুষ্য’ পরিচয় হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছে।

সত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব উদ্বাস্তু শিবিরে রয়ে গেছে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যারা বাংলাভাগের বেদনাকে এখনও বহন করে চলেছে। তানভীর মোকাম্মেল আমাদেরকে নিয়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের সেইসব উদ্বাস্তু শিবিরে, যেখানে বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধানের হাহাকার এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া ক্যাম্প, ভদ্রকালি ক্যাম্প, কিংবা যাদবপুরের বাস্তুহারা কলোনিতে বেঁচে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে, যারা এখনও ভুলতে পারেননি দেশভাগের বেদনা। পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা ভিটেমাটির জন্য তাদের স্মৃতিকাতরতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, আবার শুরুর দিনগুলোয় ক্যাম্পে অন্নহীন, বস্ত্রহীন অবস্থায় যে ভয়াবহ দুঃসময় তারা পেরিয়ে এসেছেন, অনেকে আবার সে দিনগুলোকেই বেশি স্মরণ করেছেন। কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্তসহ নানা রোগে মারা গেছে অনেক মানুষ। স্বল্প জায়গায় গবাদি পশুর মত আটকে থেকে বাস করতে হয়েছে গোটা পরিবারের সদস্যদেরকে।

উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নামে অনেককে পাঠানো হয়েছে সুদূর মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে, রামায়ণে উল্লেখিত সেই অনুর্বর ভূমিতে যেখানে নির্বাসিত রাম ও সীতা আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেই জায়গা পরিষ্কার করে ফসল ফলিয়ে তারা কোন রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। সেই দণ্ডকারণ্যে বসেও তারা স্বপ্ন দেখেছে নিজ জন্মভূমির আশপাশে ফেরার। ১৯৭৮-৭৯ সালে সুযোগ এসেছিল সুন্দরবনের কাছাকাছি মরিচঝাঁপি নামক দ্বীপে পুনর্বাসনের। কিন্তু রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেঙে যায় সে স্বপ্ন, মরিচঝাঁপিতে আবাস স্থাপনের পর ট্রাকে করে তাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় দণ্ডকারণ্যে। অনেককে আবার পাঠানো হয় উত্তরখণ্ডের নৈনিতালে, সুদূর আন্দামান দ্বীপে- যে দ্বীপ দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহৃত হয়েছে দাগী অপরাধীদের নির্বাসিত করার স্থান হিসেবে।

দেখা গেছে, ভারত সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্পের মধ্যে আন্দামান দ্বীপের পুনর্বাসন প্রকল্পটিই তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল নিজে একজন শিল্পী এবং শিল্পী হিসেবে সমাজ ও ইতিহাসের প্রতি তিনি দায়বদ্ধতা অনুভব করেছেন। ইতিহাসের পাতায় দেশভাগ না খুঁজে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন মানুষের কাছে। তাদের গল্প থেকে তিনি জানতে এবং জানাতে চেয়েছেন দেশভাগকে। বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তাদের জীবনে দেশভাগের প্রভাব বুঝতে চাওয়া, তার এই প্রচেষ্টারই ফসল। নতুন পরিবেশে বাস করতে গিয়ে বাংলাভাষীরা কীভাবে নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে প্রজন্মান্তরে হারিয়ে ফেলছে, তার সকরুণ বর্ণনা বেদনাহত করে দর্শককে।

বাংলাভাগের ফলে সবচেয়ে করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে অভিভাবকহীন নারীরা। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে বৃদ্ধ বয়সে তাদের জায়গা হয়েছে পিএল ক্যাম্প বা Permanent Liability ক্যাম্পে। পরিবার পরিজন সবাইকে হারানোর বেদনা বুকে পাথর হয়ে এখনও চেপে বসে আছে তাদের অনেকের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়বহতা স্মরণ করে কেউ বলেন, “দাঙ্গার সময় আমার পরিবারের ৩৬ জনকে মেরে ফেলেছে।” আবার কেউ বলেন, “চোখের সামনে ছোটভাইটারে কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল”; “বাবার কাটা দেহ এসে পড়ল মায়ের পাশে”। দশ বছর বয়সে বিয়ের পর তেরো বছর বয়সে দাঙ্গার কারণে বিধবা হয়েছেন কেউ।

হিন্দু-মুসলমান তিক্ত সম্পর্কের শুরুটা ঠিক যেখান থেকে হয়েছে, সেই পুরনো সময়ের আঁচ তাদের কথা থেকে যেন কিছুটা অনুভব হয়। দেশভাগ নিয়ে তাদের কেউ বা নিঃস্পৃহ, আবার কারো কারো মধ্যে এখন ক্ষোভের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। বরিশালের মুলাদি, পাবনা অথবা নড়াইলের মধুমতী নদীর পারের সে সব ছিন্নমূল মানুষেরা কেউ বা সবকিছু মেনে নিয়ে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, আবার কেউ বা ঐ সময়টার ভার বহন করে চলেছেন অদ্যাবধি।

দেশভাগের সাক্ষী এবং বর্তমান সময়ের গুণী ক’জন মানুষ- জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রমুখের সাক্ষাৎকার এই প্রামাণ্যচিত্রকে ঋদ্ধ করেছে। পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছন তানভীর মোকাম্মেল। মূলত সকল শ্রেণির মানুষ বাংলাভাগকে সত্তর বছর পর কেমনভাবে দেখছেন, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। দেখা যায়, চিন্তাশীল এবং সুবিবেচক মানুষেরা বাংলাভাগকে দেখেছেন একটি ‘ব্যর্থ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে। হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘বাঙালি’ পরিচয়টাই তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।

বাংলাভাগের প্রভাব পাই শিল্প এবং সাহিত্যেও। ঋত্বিক ঘটক বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা আজীবন এই বেদনা দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। যদিও বাংলাভাগ থেকে বাঙালি মুসলমানরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও তাদের অংশটি এই প্রামাণ্যচিত্রে যেন কিছুটা উপেক্ষিত মনে হয়।

দেশভাগের এই দগদগে ক্ষত থেকেই ভারত ও বাংলাদেশ- দু’দেশের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে সীমান্তরেখা।তানভীর মোকাম্মেল বুঝতে চেয়েছেন,

“কি এই সীমান্তরেখা? এ কি ভারত ও বাংলাদেশ- দু’দেশের মাঝে বিভাজন না কি, হিন্দু মুসলমান- দু’ সম্প্রদায়ের মাঝে বিভাজন? কি সেই পার্থক্য যার জন্য মিলতে পারে না দু’বাংলার মানুষ?”

পর্যায়ক্রমে চলে আসে ফেলানীর কথা। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যার নৃশংস মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছিল সবাইকে। মনে হতে পারে তবে শুধুই কি বিভেদ? সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি কি কিছু নেই? সম্প্রীতির উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোও চমৎকারভাবে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। সময়ের সাথে দুই বাংলার মাঝে যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার বেড়াজাল ভেঙে কিভাবে সম্প্রীতি স্থাপন করা যায় তা নিয়ে কিছু প্রস্তাবনাও প্রকাশ পেয়েছে এখানে।

২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই প্রামাণ্যচিত্রটি দেখার সময় একঘেয়েমি আসা অস্বাভাবিক নয়, তবে তানভীর মোকাম্মেলের কণ্ঠের বর্ণনা এবং আবহসংগীত সেই একঘেয়েমি অনেকাংশেই দূর করে দেয়। বাংলাভাগের বেদনাকে বুঝতে হলে প্রায় তিন বছরের গবেষণার ফসল এই প্রামাণ্যচিত্রটিকে তাই উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।

তানভীর মোকাম্মেল ঠিক যেমনটা বলেছেন, দেশভাগ এমন এক বেদনা, যে বেদনা প্রকাশের ভাষা এখনও তৈরি হয় নি। শেকড় ছেঁড়া মানুষের আর্তনাদ তাই মিশে আছে পুরো ‘সীমান্তরেখা’ জুড়ে। বাংলাভাগের মর্মন্তুদ বেদনা ও হাহাকার থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত’ সমাজ ও প্রজন্ম গড়ে তোলার এখনই সময়।

কান্তজীউর মন্দির

কান্তনগর মন্দির

একটি প্রাচীন মন্দির

Kantaji Temple Dinajpur Bangladesh (12).JPG

কান্তজীউ মন্দির বা কান্তজির মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। এটি নবরত্ন মন্দির নামেও পরিচিত কারণ তিনতলাবিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিলো। কান্তজীউ মন্দির ১৮ শতকে নির্মিত একটি চমৎকার ধর্মীয় স্থাপনা। মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত যা অতিলৌকিক রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বাংলায় প্রচলিত। ধারণা করা হয়, মহারাজা সুমিত ধর শান্ত এখানেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।[১] ২০১৭ সালের কলকাতা বইমেলায় এই মন্দিরের আদলে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন করা হয়।[২] ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই মন্দির ধ্বংস হওয়ার আগে রাবণেষু, জন হেনরি এর ১৮৭১ সালে তোলা ছবিতে মন্দিরের নয়টি রত্ন বর্তমান।কান্তনগর মন্দিরধর্মঅন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্মশ্বরকৃষ্ণঅবস্থানঅবস্থানদিনাজপুরবাংলাদেশ

কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
কান্তনগর মন্দির

বাংলাদেশে অবস্থানভৌগোলিক স্থানাঙ্ক২৫°৪৭′২৬″ উত্তর ৮৮°৪০′০০″ পূর্বস্থাপত্যধরননবরত্নবাংলার মন্দির স্থাপত্যসৃষ্টিকারীমহারাজা রামনাথসম্পূর্ণ হয়১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ

কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুরবাংলাদেশ, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ছবিতে নয়টি রত্নের সাতটি দৃশ্যমান রয়েছে,একটি ভূমিকম্পে বিখ্যাত এই নবরত্ন মন্দিরের রত্নসমূহ বিলীন হয়ে যায়

অবস্থানসম্পাদনা

মন্দিরের বর্তমান অবস্থা

দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে এক শান্ত নিভৃতগ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দির

ইতিহাসসম্পাদনা

মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়টি শিখর বাদে মন্দিরটির ব্যাপক পুনর্গঠন করেছিলেন। ধারণা করা হয়, গঙারামপুরের (দিনাজপুর) নিকট বাননগরের প্রাচীর ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্মাণ উপকরণ এনে এটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রচলিত ধারণা মতে মহারাজ প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে এ মন্দিরটি তৈরি করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সাময়িকভাবে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। নবরত্ন মন্দির তৈরি সমাপ্ত হলে এ মূর্তিটি এখানে স্থানান্তর করা হয়। এটি এখন একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। এ মন্দিরটি ছিল ১৬ পার্শ্ব সম্বলিত সৌধ এবং এর উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট এবং এর দক্ষিণ দিকে প্রবেশ পথে ছিল বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান।

স্থাপত্য রীতিসম্পাদনা

বাংলার স্থাপত্যসমূহের মধ্যে বিখ্যাত এ মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে প্রাচীরের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ যুক্ত হিন্দু মন্দিরের চূড়া হতে আদি নয়টি শিখর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নির্দশন রয়েছে এ মন্দিরে। বাইরের দিকে উচুঁ করে নির্মিত তিনটি চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের নির্মাণশৈলী কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠটিকে শক্তিশালী করেছে, তাই উপরের বিরাট চূড়াটিকে এ প্রকোষ্ঠটির পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবশিষ্ট আটটি অলংকৃত চূড়া নিচের দু’তলার ছাদের আটটি কোণে সংযোজন করা হয়েছিল। নিচতলার বাঁকা কার্নিস কোণগুলিতে এসে ঝুলে আছে। এর মধ্যভাগ কিছুটা উঁচু হওয়ায় ভিত্তি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছে ২৫ ফুট, যার দ্বিতীয় তলার উচ্চতা ১৫ ফুট এবং তৃতীয় তলার ৬‘-৬‘‘। নিচের চারকোণের প্রত্যেকটির সঙ্গে একটি করে ছোট প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং এগুলি দ্বিতীয় তলার উপরে স্থাপিত কারুকার্য খচিত অষ্টকোণাকৃতির কোণের বুরুজগুলির ভর বহন করছে। নিচতলার প্রার্থনা ঘরের চারদিকে মন্দিরে মোট চারটি আয়তাকার অলিন্দ রয়েছে।নিচতলার প্রত্যেক দিকের প্রবেশ পথে বহু খাঁজ যুক্ত খিলান রয়েছে। সমৃদ্ধ অলংকরণ যুক্ত দুটি ইটের স্তম্ভ দ্বারা প্রতিটি খিলানকে পৃথক করা হয়েছে। নিচতলার চার প্রকোষ্ঠের বাইরে মোট ২১টি খিলান দরজা আছে, আর দ্বিতীয় তলায় এ খিলান দরজার সংখ্যা ২৭টি। ছোট হয়ে আসা তৃতীয় তলার মাত্র তিনটি প্রবেশ দরজা এবং তিনটি জানালা রয়েছে। পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে ২‘-৩‘‘প্রশস্ত সংর্কীণ সিঁড়ি পথ উপরে উঠে গিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ প্রবেশ পথ এঁকে বেঁকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় উঠে গিয়েছে।পূজারীদের চালার বাইরে প্রধান মন্দিরের প্রায় একশগজ দূরে আগাছায় ছাওয়া একটি এক চূড়া বিশিষ্ট ছোট ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির রয়েছে। মন্দিরের গায়ে অংকিত টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলক রয়েছে।

বিস্তারিতসম্পাদনা

এ জমাকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলির উপরে মোট নয়টি অলংকৃত শিখর বা রত্ন রয়েছে যা দেখে মনে হয় যেন একটি উচুঁ ভিত্তির উপর প্রকান্ড অলংকৃত রথ দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যে কোন দিক থেকেই পূজারীরা ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তিকে দেখতে পায়।বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত। এর চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান যা ঢেউ টিন দ্বারা আচ্ছাদিত। বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারত নির্মিত হয়েছে। পাথরের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুটেরও বেশি।

অলংকরণসম্পাদনা

মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণমহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০-এর মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে।[৩] উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে।

নকশা ও কারুকার্যের বিবরণসম্পাদনা

শিল্পীগণ অত্যন্ত উচ্চমানের পরিশীলিত এবং পরিণত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, যেখানে সমন্বিত ধারায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অলঙ্করণ করা হয়েছিল। বিচ্ছিন্ন ধারায় প্রাচীন শিল্প ঐতিহ্যের বিপরীতে এবং কিছুটা অসংলগ্ন বিন্যাসে এ মন্দিরের শিল্পের সমন্বয় ঘটেছিল বেশ কিছু স্বতন্ত্র ফলকে এবং বিস্তৃতভাবে শিল্প প্রকরণের যে সমন্বিত রুপের প্রকাশ ঘটেছিল তার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ লক্ষ করা যায়। এরই প্রভাবে কার্পেট ও অন্যান্য সূচী শিল্পে এ ঐশ্বর্যশালী অলঙ্করনের ব্যবহার প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। পোড়ামাটির অলংকরণ ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরে দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মনুষ্য মূতি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের বিস্তৃত কাহিনী এবং অসংখ্য পাত্র-পাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে। কৃষ্ণের নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র প্রতিভাত হয়েছে। পোড়ামাটির এ শিল্পগুলির বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এত যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, বাংলার যে কোন ম্যূরাল চিত্রের চেয়ে তা অনেক উৎকৃষ্ট। কেউ যদি মন্দির দেয়ালের অলংকরণের দৃশ্য যে কোন দিক থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখেন এবং বিষয়বস্তুকে সমন্বিত করেন, তবে এর বিষয় বৈচিত্র দেখে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হবেন। মন্দিরের বাইরের দেয়ালের পোড়ামাটির অলংকরণের সাধারণ যে চিত্র, তাতে চারদিকের ভিত্তি প্যানেলের নিম্নাংশে চিত্রগুলি সমান্তরাল ভাবে চারটি প্রবেশ পত্রের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। এ দিক থেকে ভিত্তির উপরে যেসব নকশা রয়েছে তা হল-

  • লতা পাতার মধ্যে প্রস্ফুটিত গোলাপ এবং এর বিকল্প হিসেবে কোথাও চারটি ধাতুর পাতে ধাতব প্রলেপযুক্ত ডিজাইন
  • স্তম্ভের কার্নিসে যে প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার মধ্যে সমসাময়িক সামাজিক চিত্র ও মাটির খন্ডে তৈরী অভিজাত জমিদারদের শিকারের দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে *উপরের সমান্তরাল প্যানেলে সূক্ষ্ম জটিল অলংকরণের মাঝে প্রস্ফুটিত গোলাপ ছিল

এসব নকশা সাধারণত ষাট গম্বুজ মসজিদবাঘা মসজিদকুসুম্বা মসজিদ ও ছোট সোনা মসজিদ প্রভৃতির গায়ে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের অলংকরণের উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ হচ্ছে বনের ভেতর শিকার দৃশ্য, হাতি, ঘোড়া, উট সহযোগে রাজকীয় শোভাযাত্রা এবং অভিজাতদের জন্য চমৎকারভাবে তৈরী গরুর গাড়ি। তাদের গায়ে ছিল মুগল পোশাক ও অস্ত্র। সুন্দরভাবে সজ্জিত হাতি এবং ঘোড়া। এদের সঙ্গে যুক্ত রথসমূহ কারুকার্য সমৃদ্ধ ছিল। অলংকৃত পালকিতে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা নাদুস-নুদুস দেহের জমিদার, হাতে তার বিলাসী হুক্কা। হুক্কার অন্যদিকে লম্বা নল থেকে ধূঁয়ার কুন্ডুলি ছুড়ছেন। অন্যদিকে নদীর দৃশ্য রয়েছে, যেখানে লোকজনে ঠাসা সর লম্বা নৌকায় সকলে আন্দোৎসবে মগ্ন।ছোট ছোট সৈন্যদলের গায়ে রয়েছে ইউরোপীয় পোশাক, খোলা তলোয়ার ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় তারা এগিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় ধাপের অলঙ্করণে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রণ। এখানে লৌকিকভাবে কৃষ্ণর প্রতিকৃতি তৈরী করা হয়েছে। এ পর্যায়ের পোড়ামাটির অলঙ্করণে রয়েছে দানব রাজা কংস কিশোর কৃষ্ণকে বধ করতে উদ্ধত, কৃষ্ণ কর্তৃক রাক্ষস পাতনা এবং সারস গলার দানব বাকাসুর হত্যা, গোবর্ধন পার্বতকে উপরে ফেলে কেশি হত্যা; স্বর্প দানব কালিয়াকে দমন এবং লম্বা সরু নৌকায় কৃষ্ণের আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদি। মন্দিরের দক্ষিণ মুখে কিছু বিভ্রান্তকর দৃশ্যসহ রামায়ণের কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রামায়ণের কাহিনীর চিত্র পূর্ব প্রান্তের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে পঞ্চবটীর বনে রাম চন্দ্র, সীতা ও লক্ষণের বনবাসের রুপায়ণ রয়েছে, সূর্পনখার নাকে আঘাতরত লক্ষণ, দন্ডকের বন থেকে রাবন কর্তৃক সীতা অপহরণ; রাবণের রথকে বাঁধা প্রদানে জটায়ুর ব্যর্থ প্রচেষ্টা, অশোক বনে সীতার বন্দি জীবন; কিশকিন্দিয়ার সিংহাসনের জন্য বালী এবং বানর অনুসারী সহ সুগ্রীভের যুদ্ধ। এছাড়াও আকর্ষণীয় ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাম চন্দ্রের সপ্ততলা বেদ এবং বানর অনুসারীসহ রামচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় রত ছিলেন সুগ্রীভ। উত্তর দিকের প্রতিমূর্তিগুলির মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল কৃষ্ণ বলরাম। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কৃষ্ণের বিভিন্ন বিয়ের ছবি; গোয়ালিনী দন্ডের দু্ই মাথায় ঝোলানো শিকায় (পাটের ঝোলা) দুধ ও দৈ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। অলঙ্করণের দ্বিতীয় ধাপে একটি আকর্ষণীয় ইউরোপীয় যুদ্ধ জাহাজ খোদিত হয়েছে। এখানে সূক্ষ্ম ও বিস্তারিতভাবে দৃশ্যমান রয়েছে সৈনিক এবং কামান।পশ্চিম দিকের পুরো অংশেই তৃতীয় ধাপের সূক্ষ্ম অলঙ্করণে কৃষ্ণ কাহিনীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এ অলঙ্করণ শেষ হয়েছে মধুরার দানব রাজা কংসকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কংসের দানবাকৃতির খুনে হাতি কবল্লপীড়ার ধ্বংস, মথুরায় কংসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে কৃষ্ণকে অংশগ্রহণে বিরত করতে না পেরে রাধার জ্ঞান হারানো। এসব চিত্রের মধ্যে দন্ডের দুই প্রান্তে ঝোলানো শিকাতে দুধ ও মাখন বহন করা গোয়ালার চিত্র খুবই আকর্ষণীয়, যা এখনও গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত দৃশ্য।বহু খাঁজ বিশিষ্ট খিলানের স্প্যান্ড্রিলের উপরে সম্প্রসারিত প্যানেলে চমৎকারভাবে দৃশ্যমান করা হয়েছে মহাকাব্যগুলির প্রাণবন্ত যুদ্ধের দৃশ্যাবলি। এতে আরও দেখানো হয়েছে একটি বৃত্তের ভেতর নৃত্যরত রাধাকৃষ্ণের যুগলশূর্তিসহ রস-মন্ডল ও এর সাথে অন্যান্য সহায়ক মূর্তি। কুরুক্ষেত্র ও লঙ্কার প্রচন্ড যুদ্ধের দৃশ্যাবলি রুপায়নে স্থানীয় লোকশিল্পীদের কল্পনা ও প্রচুর প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটেছে।আপাতঃদৃষ্টিতে মন্দিরের দেওয়ালে ব্যাপকভাবে পোড়ামাটির চিত্র অলঙ্করণকারী লোকশিল্পীদের অনেকেই এসেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে। তারা তাদের পরিচিত পরিবেশের প্রভাব শিল্পকর্মে প্রতিফলিত করেছেন। প্যানেলে সূক্ষ্মভাবে চিত্রায়িত দেবতাগণের আদল কখনও কখনও বিস্ময়করভাবে তাদের সমাজের পরিচিত সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মিলে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমের সম্মুখভাগের নিচের দিকের প্যানেলের পোড়ামাটির অলঙ্করণগুলির কথা বলা যেতে পারে। এখানে কৃষ্ণ গাছ থেকে নারকেল পাড়ছিলেন এবং গাছের অর্ধেক পর্যন্ত আরোহণ করা তাঁর এক সঙ্গীর হাতে এটি তুলে দিচ্ছেন এবং নিচে অপেক্ষারত অন্য সঙ্গীর হাতে সে দিচ্ছিল নারকেলটি। এটি ছিল বাংলার একটি পরিচিত দৃশ্য। এখানে দেবতাকে এ সমাজের একজন পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। কতিপয় স্বতন্ত্র ফলক চিত্রও রয়েছে যেখানে স্বভাবিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ছিল। যেমন দক্ষিণ দিকে বারান্দার ভেতর দিকে একটি ফলক রয়েছে যেখানে রাধা-কৃষ্ণ একটি হাতির ওপর নৃত্য করছেন, একই সঙ্গে বেশ দক্ষতায় ডজন খানেক মানব মূর্তিও উৎর্কীণ করা হয়েছে। উত্তর দিকের দেওয়ালে কৃষ্ণ তাঁর একজন নবপরীণিতা স্ত্রীর সঙ্গে চাঁদোয়ার নিচে কটি পিঁড়িতে (নিচু করে তৈরী কাঠের আসন) বসেছেন। নববধু লাজনম্রভাবে অবগুন্ঠন দিয়ে আছেন এবং একহাত দিয়ে ধরে আছেন নিজের মাথা। তিনি চকিত দৃষ্টি দিচ্ছেন তাঁর প্রভুর দিকে। এটি বাংলার সুপরিচিত বিয়ের দৃশ্যের প্রতিফলন। কার্ণিসে অলংকৃত বিশৃঙ্খল জনতাদের মধ্যে হাঁটু ও পেছন দিক একটি গামছা পেঁচিয়ে (কাপড়ের টুকরো) হাঁটু ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে নির্লিপ্তভাবে বসে থাকা কৃষ্ণ, এমন দৃশ্যও কেউ খুঁজে পেতে পারেন। এ ভঙ্গি বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না। তবে এ দৃশ্যের মিল পাওয়া যায় বিহারের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে।যাহোক, কান্তজীর মন্দিরের চমৎকার পোড়ামাটির অলঙ্করণের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো যে, এতে কামদ দৃশ্যাবলির চিত্র অঙ্কন করা হয়নি, যেমনটি দেখা যায় উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরসমূহে। কান্তজীর মন্দিরের দেওয়ালের ওপর পোড়ামাটির এ বিশাল অলঙ্করণ সে সময়ের জীব ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ ছিল এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই এ শিল্প বেড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের মতো এমন ব্যাপক উর্বর পলিময় ভূমিতে পাথরের অভাব হেতু দেশীয় ধারায় পোড়ামাটি শিল্পের বিকাশ যৌক্তিক কারণেই ঘটেছিল। আদি ঐতিহাসিক যুগে, বিশেষ করে পাল চন্দ্র বংশের আমলে যখন পাহাড়পুর, ময়নামতী, ভাসু বিহার এবং সিতাকোটে বৌদ্ধ মন্দির এবং অন্যান্য ইমারতসমূহ লতা-পাতা ও পোড়ামাটির মূর্তি দিয়ে প্রাণবন্ত ছিল, তখন থেকেই এ রুপকারক শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। এ সমস্ত পোড়ামাটির ফলক ছিল বড় আকৃতির এবং কিছুটা সেকেলে ধরনের। কিন্তু কান্তনগর মন্দিরের দেওয়াল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির।

আদলে গড়েন।[২]

চিত্রসম্ভারসম্পাদনা


কান্তজির মন্দির
মন্দিরের সম্মুখদৃশ্য

পোড়ামাটির ফলক

পোড়ামাটির ফলক

পোড়ামাটির ফলক
পাথরে খোদিত শ্লোক
মন্দিরের সুদৃশ্য টেরাকোটা ও চিত্ত শৈলী
মন্দিরের শিব মন্দির
কান্তনগর মন্দিরের রাঁধাকৃষ্ণ মূর্তি

দুই রাজ্যের দুই প্রাচীন রথযাত্রার কথা-ওডিশা ও বাংলা

‘‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
ভক্তেরা লুটায় পথে করিছে প্রণাম!
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী!’’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরী: ওডিশার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব

পণ্ডিতেরা বলেন, হিন্দু ধর্মের আর পাঁচটা উত্‍‌সবের মতো রথযাত্রাও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির এক মিশ্রনে তৈরি এক লোকাচার। শাস্ত্রগ্রন্থ ও কিংবদন্তী অনুসারে বলা হয়ে বলা হয়, কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকার সমুদ্রীতীরে মৃতদেহ পোড়াবার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সত্‍‌কার কার্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ওই অর্ধদগ্ধ দেহাংশ সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূলে কলিঙ্গ রাজ্যে এসে পৌঁছয়। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী এক দল শবর তাদের নেতা বিশ্বাবসুর নেতৃত্বে গভীর জঙ্গলে মন্দির নির্মাণ করে ওই দেহাংশকে ‘নীলমাধব’ দেবতাজ্ঞানে পুজো করতে আরম্ভ করে। নীলমাধবের খ্যাতি শুনে প্রাচীন অবন্তী নগরীর বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তা হস্তগত করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। বিশ্বাবসুর কাছে পরাজিত ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন বিষ্ণুর প্রার্থনা আরম্ভ করেন।

ইন্দ্রদ্যুম্নর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁকে নির্দেশ দেন যে পুরীর সমুদ্রতীরে এক নিমকাষ্ঠ খণ্ড ভেসে আসবে তা থেকে যোগ্য কারিগর দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করে পুজো করতে হবে। যথা সময়ে পুরীর সমুদ্রতীরে চক্রতীর্থ অঞ্চলে একটি বড়ো নিমকাঠের গুঁড়ি ভেসে আসে। তা দিয়ে বিশ্বকর্মা ভাস্করের ছদ্মবেশে দেবতার বিগ্রহ তৈরি আরম্ভ করেন। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরির আগে রাজাকে শর্ত দেন যে, মূর্তি তৈরির জন্য একুশ দিন সময় দিতে হবে এবং মূর্তির নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ ওই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশ্বকর্মা সময় চাইলেও নির্মাণকার্যে দেরি দেখে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রানি গুণ্ডিচা অধৈর্য হয়ে পনের দিনের মাথায় দরজা খুলে ফেললে মূর্তি অসম্পূর্ণ রেখেই বিশ্বকর্মা অন্তর্হিত হন। তখন বিষ্ণুর নির্দেশে ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধসমাপ্ত জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।

jagannath-rath_internet.jpg

জগন্নাথের প্রধান উত্‍‌সব হল রথযাত্রা। কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়— আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যান (সেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’) এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। স্থানীয় ভাবে এটি মাসির বাড়ি যাওয়া নামে পরিচিত! রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও উল্টোরথ বলা হয়। ‘রথযাত্রা’ আবার পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাবেদীযাত্রা, নন্দীঘোষযাত্রা নামেও পরিচিত।

রথযাত্রায় তিন বিগ্রহের জন্য তৈরি হয় তিনটি পৃথক রথ। জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। এছাড়াও ওই রথকে চক্রধ্বজ বা গরুড়ধ্বজও বলা হয়। জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষ-এর উচ্চতা ৪৫ ফুট। এতে থাকে ১৮টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। পুরো রথটি লাল-হলুদ কাপড়ে মোড়া হয়। পীত বা হলুদ রঙের কাপড় কৃষ্ণের খুব পছন্দ বলে কৃষ্ণের অন্য নাম পীতাম্বর। এবং জগন্নাথ কৃষ্ণের এক রূপ বলে জগন্নাথের রথ মোড়া হয় লাল ও হলুদ কাপড় দিয়ে। শীর্ষে তালগাছের নিশান ওড়ে তাই বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। এর উচ্চতা ৪৪ ফুট। এতে আছে ১৬ টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। এই রথ লাল-নীল কাপড়ে মোড়া থাকে। সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। এর অর্থ হল অহংকে বধ করা। এই রথের উচ্চতা ৪৩ফুট, এতে আছে ১৪টি চাকা, যার প্রতিটির ব্যস ৭ফুট। ওই রথটি লাল-কালো কাপড়ে মোড়া থাকে। কালো শক্তি তথা দেবীমাতৃকার প্রতীক তাই ওই রং। রথের দিন প্রতিটি রথকে পঞ্চাশ গজ দড়িতে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাড়ি। সেখানে সাত দিন বিগ্রহ তিনটি থাকে আবার উল্টোরথের দিন একই ভাবে রথে তুলে মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।

মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব

দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রে না হলেও রথযাত্রাও বাংলার একটি অন্যতম বড়ো উত্‍‌সব। প্রাথমিক ভাবে ওডিশার উত্‍‌সব হলেও শ্রীচৈতন্যর সূত্রে রথযাত্রা বঙ্গদেশেও যথেষ্ঠ জনপ্রিয় উত্‍‌সব হিসেবে পালিত হয়। বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি সম্ভবত এসেছে শ্রীচৈতন্যর নীলাচল অর্থাত্‍‌ পুরী গমনের পরে। শ্রীচৈতন্যর নির্দেশে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। তবে ঠিক কবে কোথায় প্রথম রথটি টানা হয়েছিল তা বলা কঠিন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। তবে পুরীর মতো তিনটি নয়, একটি মাত্র রথেই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ তুলে রথযাত্রা হয়।

mahesh_jagannathtemple01_gb.jpg

(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

mahesh_jagannathtemple02_gb.jpg


(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও রয়েছে তথ্যের অভাব। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়ে থাকে পুরীর দেবতা জগন্নাথ নাকি গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে মাহেশে এসে সেখানে থেকে যেতে মনস্থ করেন, এবং সেই অনুসারে সেখানে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয় ইতিহাস-পূর্বকালে। তবে ইতিহাস বলে, চৈতন্য সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সে মন্দির ভগ্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বড়োবাজারের মল্লিক পরিবারের নিমাইচরণ মল্লিকের দানে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির তৈরি হয়। শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে তাঁর ভক্ত কমলাকর পিপলাই আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানেও তাঁর বংশধরেরা ওই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

mahesh_jagannathidol01_gbm.jpg


(মাহেশের মন্দিরে বিগ্রহ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

মাহেশের রথের সঙ্গেও কলকাতার সম্পর্ক গভীর। কথিত আছে মাহেশের প্রথম রথ নির্মাণ করিয়ে দেন জনৈক মোদক। কালের নিয়মে সে রথও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এক সময়ে কলকাতার শ্যামবাজার বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু একটি পঞ্চচূড় রথ তৈরি করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাহেশ জগন্নাথ মন্দির থেকে ‘মাসির বাড়ি’ পর্যন্ত রথ চলাচলের উপযোগী পাকা রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন, সেই সঙ্গে রাস্তার দু’পাশে অনেকটা করে জায়গাও কিনে মন্দিরকে দান করেন বড়ো আকারের রথের মেলা বসবার জন্য। পরে তিনি হুগলির কালেক্টরির দেওয়ানি পেয়ে জগন্নাথ মন্দিরের জন্য প্রচুর ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যান, যার আয় থেকে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হতে পারে। কৃষ্ণরামের তৈরি কাঠের রথ আগুনে পুড়ে গেলে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন বটে কিন্তু পুণ্যের লোভে জনৈক ব্যক্তি ওই রথের তলায় আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয়। গুরুপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র কালাচাঁদ নতুন একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন। সেটি জীর্ণ হলে কালাচাঁদের জ্যেষ্ঠ পৌত্র বিশ্বম্ভর একটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন। কিন্তু সেটিও আগুনে পুড়ে যায়।
বার বার আগুনে পুড়ে রথ নষ্ট হওয়া আটকাতে বিশ্বম্ভরের ছোটো ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে ১২৫ টন ওজনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক বিশাল রথ নির্মাণ করিয়ে দেন সে যুগের অন্যতম নির্মাণ-স্থপতি সংস্থা ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানি’কে দিয়ে আর সে রথের নকশা করেন ভারতের প্রথম পাশ্চাত্যধারার স্থপতি নীলমণি মিত্র।

মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সম্প্রীতির কাহিনিও। সপ্তগ্রামের বোড়ো পরগনার জায়গিরদার নবাব খাঁনে আলি খাঁন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করবার সময় এক বার ঝড়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। মন্দিরের তত্‍‌কালীন সেবায়েত রাজীব অধিকারীর আপ্যায়ণে সন্তুষ্ট হয়ে নবাব খাঁনে আলি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অঞ্চলের জগন্নাথপুরকে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের নামে লিখিত দলিলের মাধ্যমে নিষ্কর দেবোত্তর করে দেন। পরে মাহেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে এলে কোম্পানিও সেই দলিলকে মান্যতা দিয়ে ওই পরগনা নিষ্কর ঘোষণা করে।

mahesh_rath01.jpg


(মাহেশের রথ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

বিত্তবান ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিদের সহায়তায় এক সময় মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্‍‌সবে পরিণত হয়েছিল। কালের প্রভাবে আজ সেই শ্রেষ্ঠত্ব হয়ত বজায় নেই তবে এখনও বাংলার এই প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব দেখতে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তার কৃতিত্ব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত কমলাকর পিপলাইয়ের উত্তরপুরুষ অধিকারীরা এবং রথের ব্যবস্থাপক শ্যামবাজার বসু পরিবারের সদস্যদেরই প্রাপ্য।

লিখেছেন- গৌতম বসুমল্লিক

মুরুদেশ্বর মহাদেবের মন্দির

মুরুদেশ্বর

মুরুদেশ্বর,দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উত্তর কন্নড় জেলার ভটকল তহশিলের একটি অতিপরিচিত শহর৷ মুরুদেশ্বর হিন্দুদেবতা শিবের অপর নাম৷ আরব সাগরের তীরে অবস্থিত শহরটি বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শিব মূর্তি ও মুরুদেশ্বর মন্দিরের জন্য বিখ্যাত৷ মুরুদেশ্বর রেলওয়ে স্টেশনটি ম্যাঙ্গালোর থেকে মুম্বাই অবধি বিস্তৃৃত কোঙ্কণ রেলপথের অন্তর্গত৷

নামকরণ ও পৌরাণিক কথাসম্পাদনা

মুরুদেশ্বর মন্দিরের বাইরের শিবমূর্তি

মুরুদেশ্বর নামটি রামায়ণের সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয়৷

হিন্দু দেব-দেবীরা আত্মালিঙ্গ প্রকারের দিব্যপ্রতীকের পূজার্চনার মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করতেন৷ তেমনই লঙ্কার রাজা রাবণ অমরত্বলাভের ইচ্ছায় শিবের আত্মার প্রতীক আত্মালিঙ্গ পূজনে ব্রতী হন৷ ফলে রাবণ শিবের নিত্যপূজা শুরু করেন৷ মহেশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বরদান করেন ও রাবণ তাঁর থেকে আত্মালিঙ্গ প্রাপ্তির ইচ্ছা প্রকাশ করে৷ শিব সম্মতিদান করেন ও পুর্বসতর্ক করেন যেন রাবণ এই মূর্তি তাঁর রাজ্যে গিয়েই স্থাপিত করেন, নতুবা এই লিঙ্গ যেখানে ভূস্পর্শ করবে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যাবে৷ এই বরদান পেয়ে আত্মালিঙ্গসহ রাবণ নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন৷

শ্রী বিষ্ণু সমগ্র ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত হন ও রাবণের অমরত্বপ্রাপ্তির ফলাফল উপলব্ধি করেন৷ তিনি শিবপুত্র গণেশকে প্রেরণ করেন যেন রাবণ এই আত্মালিঙ্গ কখনোই নিজরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে৷ স্কন্দপুর্বজ জানতেন রাবণ কখনো তার সান্ধ্য-আহ্নিক সব দৈনিক অন্যান্য পূজার কাজ অসম্পুর্ণ রাখেন না৷ এই সুযোগই তিনি ব্যবহার করেন আত্মালিঙ্গ পুণরুদ্ধারের জন্য৷

লঙ্কেশ্বরের যাত্রাপথে গোকর্ণের নিকট উপস্থিত হলে বিষ্ণু মায়াবলে ছদ্মসূর্যাস্ত ও সান্ধ্য আবহাওয়ার প্রকাশ ঘটান৷ এমন সময় রাবণের সান্ধ্য-আহ্নিকের কথা স্মরণ হয় ও শিবদত্ত আত্মালিঙ্গের ভুনিবেশের কথা মনে করে বিচলিত হন৷ এমন সময় শ্রীশশিবর্ণ নাম্নী ব্রাহ্মণবালকবেশে গণেশ এসে উপস্থিত হলে রাবণ পূজার্চনার কাজ সম্পন্ন না হওয়া অবধি তাঁকে আত্মালিঙ্গের দায়িত্ব প্রদান করেন৷ শ্রীবিনায়ক এই শর্তে রাজী হন যে তিনি রাবণকে তৃৃতীয়বার ডাকির পর ও না এলে তিনি দায়িত্বসারা হবেন৷

যথাপি রাবণ ফিরে এসে দেখেন আত্মালিঙ্গটি ভূস্থাপিত হয়েছে৷ কেশব তখন পুণরায় তার মায়ার নিষ্পত্তি ঘটালে সূর্যোদয় ঘটে৷ রাবণ তার প্রতি হওয়া ছলনার কথা বুঝতে পারেন ও লিঙ্গ উদ্ধারের চেষ্টা করলে কিছু টুকরো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে৷ তেমনই একটি টুকরো সুরাৎকলে এসে পড়ে ও প্রতিষ্ঠা পায় সদাশিব মন্দির৷ পরে তিনি লিঙ্গমুখারকটি নষ্ট করার চেষ্টা করলে তা ৩৭ কিলোমিটার দূর সজ্জেশ্বরে পতিত হয়৷ আবরকের নিম্নাংশ ১৬ ও ১৯ কিলোমিটার দূরে গুণেশ্বর ও ধরেশ্বরে পতিত হয়৷

অন্তিমে রাবণ আত্মালিঙ্গের বস্ত্র ছুড়ে ফেলেন যা কণ্ডুকাগিরি অঞ্চলের মৃৃধেশ্বরে পতিত হয়, এই মৃৃধেশ্বর কালক্রমে মুরুদেশ্বর নামে পরিণত হয়৷

চিত্তাকর্ষক স্থানসম্পাদনা

বিংশতিতলবিশিষ্ট মুরুদেশ্বর শিব মন্দিরের সুউচ্চ গোপুরম
  • মুরুদেশ্বর মন্দির ও রাজগোপুরা: ভব্যমন্দিরটি কর্ণাটকের তিনদিকে আরব সাগর দ্বারা বেষ্টিত কণ্ডুকাগিরিতে অবস্থিত৷ কুড়িতল বিশিষ্ট গোপুরমটি ৺শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত৷ ২৪০ ফুট উঁচু রাজগোপুরার উচ্চতল থেকে ১২৩ ফুট শিবমূর্তি পরিদর্শনের সুবন্দোবস্ত রয়েছে৷ পাহাড়ের পাদদেশে একটি রামেশ্বর শিবমন্দির ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, তাছাড়া শ্রীঅক্ষয়গুণ শিবলিঙ্গ শানেশ্বর মূর্তি ও রয়েছে৷
  • বিস্তৃৃত সমুদ্রসৈকত ও নৌবহরের ব্যবস্থা রয়েছে৷
  • দ্বিতীয় উচ্চতম শিবমূর্তিটি এখানেই অবস্থিত৷[১][২][৩]

  • মুরুদেশ্বর মন্দিরের গোপুরম

  • মুরুদেশ্বর মন্দিরের শিখর

  • মুরুদেশ্বর সমুদ্রসৈকত

  • মুরুদেশ্বরের সম্পুর্ণ দৃৃশ্য

  • জগন্নাথ দেবের অমৃত কথা

    515_J-15

    মালবরাজ ইন্দ্রদুম্ন্য ছিলেন পরম বিষ্ণু ভক্ত। একদিন এক তেজস্বী সন্ন্যাসী তাঁর রাজবাড়ীতে পদার্পণ করলেন । দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ন রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য পরম যত্নে সন্ন্যাসীর সেবা যত্ন করলেন । সন্ন্যাসী ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থের কথা বলে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের নীল পর্বতে ভগবান বিষ্ণুর পূজার কথা জানালেন । এখানে ভগবান বিষ্ণু গুপ্তভাবে শবর দের দ্বারা নীলমাধব রূপে পূজিত হচ্ছেন । নীলমাধব সাক্ষাৎ মুক্তিপ্রদায়ক । তিনি মোক্ষ প্রদান করেন ।
    সন্ন্যাসীর কথা শুনে ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য ভগবানের রূপ দর্শনে আকুল হলেন । রাজা তাঁর পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে শবর দের রাজ্যে গিয়ে নীলমাধবের সন্ধান করে আনতে বললেন । এরপর শবর দের দেশে এসে বিদ্যাপতি শবর দের রাজা বিশ্বাবসুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন । বিশ্বাবসু মারফৎ বিদ্যাপতি নীলমাধব কে দর্শন লাভ করলেন । তারপর বিদ্যাপতি গিয়ে রাজাকে সব জানালেন । রাজা খবর পেয়ে সৈন্য সামন্ত নিয়ে নীলমাধবের দর্শনে আসলেন ।
    ইন্দ্রদুম্ন্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এসে নীলমাধব দর্শন করতে গেলে শুনলেন নীলমাধব অন্তর্ধান করেছেন । মতান্তরে শবর রাজ বিশ্বাবসু সেটিকে লুকিয়ে রাখেন । রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য এতে খুব দুঃখ পেয়ে ভাবলেন প্রভুর যখন দর্শন পেলাম না তখন এই জীবন রেখে কি লাভ ? অনশনে প্রান ত্যাগ করাই শ্রেয় । এই ভেবে রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কুশ শয্যায় শয়ন করলেন । সেসময় দেবর্ষি নারদ মুনি জানালেন – “হে রাজন তোমার প্রাণত্যাগের প্রয়োজন নাই ।
    এই স্থানে তোমার মাধ্যমে ভগবান জগন্নাথ দেব দারুব্রহ্ম রূপে পূজা পাবেন । স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা একথা জানিয়েছেন।” রাজা শুনে শান্তি পেলেন। এক রাতের কথা রাজা শয়নে ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্ন পেলেন । স্বপ্নে ভগবান শ্রীহরি বললেন- “হে রাজন । তুমি আমার প্রিয় ভক্ত। ভক্তদের থেকে আমি কদাপি দূর হই না। আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।” রাজা সেই স্থানে গিয়ে দারুব্রহ্মের সন্ধান পেলেন। কিন্তু তাকে একচুল ও নরাতে পারলেন না । রাজা আদেশ দিলেন হাতী দিয়ে টানতে । সহস্র হাতী টেনেও সেই দারুব্রহ্ম কে একচুল নড়াতে পারলো না ।
    রাজা আবার হতাশ হলেন । সেই সময় ভগবান বিষ্ণু স্বপ্নে জানালেন- “হে রাজন। তুমি হতাশ হইও না । শবর রাজ বিশ্বাবসু আমার পরম ভক্ত । তুমি তাকে সসম্মানে এইস্থানে নিয়ে আসো। আর একটি স্বর্ণ রথ আনয়ন করো।” রাজা সেই মতো কাজ করলেন । ভক্ত বিশ্বাবসু আসলো । বিশ্বাবসু , বিদ্যাপতি আর রাজা তিনজনে মিলে দারুব্রহ্ম তুললেন । সেসময় চতুর্দিকে ভক্তেরা কীর্তন করতে লাগলো । তারপর দারুব্রহ্ম কে রথে বসিয়ে নিয়ে এলেন ।

    রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য সমুদ্রে প্রাপ্ত দারুব্রহ্ম প্রাপ্তির পর গুণ্ডিচা মন্দিরে মহাবেদী নির্মাণ করে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন । ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় সহস্র বার ভারতবর্ষের কোনো রাজাই যজ্ঞের অশ্ব ধরতে সক্ষম হোলো না । যজ্ঞ সমাপ্তে দেবর্ষি নারদ মুনির পরামর্শে রাজা সেই দারুব্রহ্ম বৃক্ষ কাটিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরীতে মনোনিবেশ করলেন । এর জন্য অনেক ছুতোর কারিগর কে ডেকে পাঠানো হোলো । কিন্তু বৃক্ষের গায়ে হাতুরী, ছেনি ইত্যাদি ঠেকানো মাত্রই যন্ত্র গুলি চূর্ণ হতে লাগলো । রাজা তো মহা সমস্যায় পড়লেন । সেসময় ছদ্দবেশে বিশ্বকর্মা মতান্তরে ভগবান বিষ্ণু এক ছুতোরের বেশে এসে মূর্তি তৈরীতে সম্মত হলেন । তিনি এসে বললেন- “হে রাজন। আমার নাম অনন্ত মহারাণা। আমি মূর্তি গড়তে পারবো । আমাকে একটি বড় ঘর ও ২১ দিন সময় দিন । আমি তৈরী করবো একটি শর্তে। আমি ২১ দিন দরজা বন্ধ করে কাজ করবো ।

    সেসময় এই ঘরে যেনো কেউ না আসে। কেউ যেনো দরজা না খোলে।” অপর দিকে মোটা পারিশ্রামিকের লোভে যে ছুতোর রা এসেছিলো তাদের কেউ নিরাশ করলেন না অনন্ত মহারাণা । তিনি বললেন- “হে রাজন । আপনি ইতিপূর্বে যে সকল কারিগর কে এনেছেন , তাদের বলুন তিনটি রথ তৈরী করতে।” ছদ্দবেশী বিশ্বকর্মা ঘরে ঢুকলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সেখানে কড়া প্রহরা বসানো হোলো যাতে কাক পক্ষীও ভেতরে না যেতে পারে । ভেতরে কাজ চলতে লাগলো । কিন্তু রানী গুণ্ডিচার মন মানে না । স্বভাবে নারীজাতির মন চঞ্চলা হয় । রানী গুন্ডিচা ভাবলেন – “আহা কেমনই বা কারিগর বদ্ধ ঘরে মূর্তি গড়ছেন । কেমন বা নির্মিত হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুর বিগ্রহ । একবার দেখেই আসি না। একবার দেখলে বোধ হয় কারিগর অসন্তুষ্ট হবেন না।” এই ভেবে মহারানী ১৪ দিনের মাথায় মতান্তরে ৯ দিনের মাথায় দরজা খুলে দিলেন । কারিগর ক্রুদ্ধ হয়ে অদৃশ্য হোলো । অসম্পূর্ণ জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন । একি মূর্তি ! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন , হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে মহারানীর মাথা ঘুরতে লাগলো ।

    রাজার কানে খবর গেলো । রাজা এসে রানীকে খুব তিরস্কার করলেন । বদ্ধ ঘরের মধ্য থেকে এক কারিগরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় বিচক্ষণ মন্ত্রী জানালেন তিনি সাধারন মানব না কোনো দেবতা হবেন । বিষ্ণু ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য তাঁর আরাধ্য হরির এই রূপ দেখে দুঃখিত হলেন । রাজাকে সেই রাত্রে ভগবান বিষ্ণু আবার স্বপ্ন দিলেন । বললেন- “আমার ইচ্ছায় দেবশিল্পী মূর্তি নির্মাণ করতে এসেছিলেন । কিন্তু শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে এই রূপ মূর্তি গঠিত হয়েছে । হে রাজন , তুমি আমার পরম ভক্ত । আমি এই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই তোমার পূজা নেবো । আমি দারুব্রহ্ম রূপে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে নিত্য অবস্থান করবো। আমি প্রাকৃত হস্তপদ রহিত , কিন্তু অপ্রাকৃত হস্তপদাদির দ্বারা ভক্তের সেবাপূজা শ্রদ্ধা গ্রহণ করবো। আমি ত্রিভুবনে সর্বত্র বিচরণ করি । লীলা মাধুর্য প্রকাশের জন্য আমি এখানে এইরূপে অধিষ্ঠান করবো। শোনো নরেশ । ভক্তেরা আমার এই রূপেই মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ রূপের দর্শন পাবেন । যদি তুমি ইচ্ছা করো তবে ঐশ্বর্য দ্বারা সোনা রূপার হস্ত পদাদি নির্মিত করে আমার সেবা করতে পারো। ”আমরা দেখেছি যে ভগবান বিষ্ণু তাঁর পরম ভক্ত রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই বলে যে তিনি সেই হস্তপদ রহিত বিকট মূর্তিতেই পূজা নেবেন । সেই স্বপ্ন পর্ব তখনো চলছে । ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে যে ভাগবতিক ও ভক্তির সম্বন্ধ তা একে একে উঠে আসছে । নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্নে রাজা তখনও সেই ছদ্দবেশী অনন্ত মহারানার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন- “হে প্রভু জনার্দন । যে বৃদ্ধ কারিগরকে দিয়ে তুমি তোমার এই মূর্তি নির্মিত করিয়াছ – আমার অভিলাষ এই যে সেই কারিগরের বংশধরেরাই যেনো তোমার সেবায় রথ যুগ যুগ ধরে প্রস্তুত করিতে পারে।” ভগবান নারায়ন তাঁর ভক্তদের খুবুই স্নেহ করেন। তাই ভগবান একে একে রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করতে লাগলেন। এরপর ভগবান বিষ্ণু বললেন- “হে রাজন। আমার আর এক পরম ভক্ত শবর রাজ বিশ্বাবসু আমাকে নীলমাধব রূপে পূজা করতো- তাঁরই বংশধরেরা আমার সেবক রূপে যুগ যুগ ধরে সেবা করবে । বিদ্যাপতির প্রথম স্ত্রীর সন্তান গন আমার পূজারী হবে। আর বিদ্যাপতির দ্বিতীয়া স্ত্রী তথা বিশ্বাবসুর পুত্রী ললিতার সন্তান এর বংশধরেরা আমার ভোগ রান্নার দায়িত্ব নেবে। আমি তাদিগের হাতেই সেবা নেবো।”
    বিদ্যাপতি প্রথম রাজার আদেশে নীলমাধব সন্ধান করতে গেছিলেন শবর দের দেশে , শবর বা সাঁওতাল যাদের আমরা ছোটোজাত বলে দূর দূর করি- শ্রীভগবান বিষ্ণু প্রথম তাঁদের দ্বারাই পূজা নিলেন । অপরদিকে তিনি তাঁদের হাতে সেবার আদেশ দিলেন। ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতির একত্র মেলবন্ধন ঘটালেন স্বয়ং ভগবান । সেজন্যই বলে পুরীতে জাতিবিচার নেই । জগতের নাথ জগন্নাথ সবার । বিদ্যাপতি শবর দেশে নীলমাধবের সন্ধান করতে গিয়ে বিশ্বাবসুর দুহিতা ললিতার সাথে ভালোবাসা ও বিবাহ করেছিলেন । আর বিদ্যাপতিকে শবর দেশে পৌছানোর জন্য এক রাখাল বালক বারবার পথ প্রদর্শন করেছিলেন । সেই রাখাল বালক আর কেউ নয় স্বয়ং বৃন্দাবনের রাখালরাজা নন্দদুলাল । ইন্দ্রদুম্ন্য স্বপ্নে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেন- “হে মধূসুদন । প্রতিদিন মাত্র এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘণ্টার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে । বাকী সময় মন্দিরের দ্বার অবারিত থাকবে , যাতে তোমার সন্তান ভক্তেরা তোমার দর্শন লাভ করে । সারাদিন আপনার ভোজোন চলবে । আপনার হাত কদাপি শুস্ক থাকবে না।”
    ভগবান বিষ্ণু রাজাকে তাই বর দিলেন। এবার ভগবান ভক্তের পরীক্ষা নিলেন- তিনি বললেন- “এবার নিজের জন্য কিছু প্রার্থনা করো। তুমি আমার ভক্ত।” প্রকৃত ভক্তেরা নিস্কাম, তাই কোনো প্রকার সুখ ঐশ্বর্য তারা চান না। রাজা একটি ভয়ানক বর চেয়ে বললেন- “প্রভু আমাকে এই বর দিন আমি যেনো নির্বংশ হই । যাতে আমার বংশধরেরা কেউ যেনো আপনার দেবালয় কে নিজ সম্পত্তি দাবী না করতে পারে।” ভগবান হরি তাই বর দিলেন। জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।

    সরলাদাসের ওড়িয়া মহাভারত, বলরাম দাসের ওড়িয়া রামায়ন, জগন্নাথ দাসের দারুব্রহ্মগীতা, অচ্যুতানন্দ দাসের হরিবংশ, দিবাকর দাসের জগন্নাথ চরিতামৃত, মহাদেব দাসের নীলাদ্রী মহোদয় ইত্যাদি গ্রন্থে জগন্নাথ দেব সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। সংস্কৃতে রচিত নীলাদ্রী মহোদয়, বামদেব সংহিতা, যাত্রা ভাগবত ইত্যাদি শাস্ত্রে জগন্নাথের কথা দেখা যায় । পদ্মপুরাণে লিখিত আছে ভগবান রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্ন এই স্থানে এসেছিলেন । ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরানে এই স্থানের নাম পাওয়া যায় ।

    জগন্নাথ মন্দিরের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় ব্রহ্মা ব্রহ্মলোক থেকে মর্তে এসেছিলেন। তিনিই হয়েছিলেন পুরোহিত । জগন্নাথ দেব রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কে স্বপ্নে নিত্য পূজোর নিয়মকানুনাদি বলেছিলেন । ইন্দ্রদুম্ন্য সেই মতো সব ব্যবস্থা করেন । স্কন্দপুরান মতে শবর জাতির লোকেরা পূর্বে নীলমাধব রূপে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করতো । ব্রহ্ম পুরাণ ও বৃহৎ নারদীয় পুরান মতে শবর গণ নীলমাধব রূপী নারায়নের পূজা করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর পূর্বে স্বর্গের দেবতা গণ গুপ্ত রূপে নীলমাধবের পূজা করতেন । পরে শবর গণ সেই খোঁজ পান । জগন্নাথ দেবের সৃষ্টি সম্বন্ধে ওড়িয়া মহাভারতে এক অদ্ভুত আখ্যান আছে । লীলা সংবরণের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৈকুণ্ঠে গমনের চিন্তা করতে লাগলেন। যদু বংশ গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে । বলরাম ভ্রাতা যোগবলে দেহ রেখেছেন । তিনি এই ভেবে বনে গিয়ে একটি বৃক্ষে আরোহণ করে মহাভারতের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সেসময় তাঁর চরণ কে পক্ষী ভেবে জরা নামক এক ব্যাধ শর বিদ্ধ করলেন ।

    বলা হয় এই ব্যাধ পূর্ব জন্মে বালী পুত্র অঙ্গদ ছিলেন । ভগবান রাম বালীকে বধ করে অঙ্গদ কে বর দিয়েছিলেন , পরবর্তী কৃষ্ণ রূপে তিনি অঙ্গদের শরে দেহ রাখবেন । পরে শ্রীকৃষ্ণ দেহ রাখলে তাঁর দেহকে দ্বারকায় সমুদ্র তটে চন্দন কাষ্ঠে, খাঁটি গো ঘৃতে দাহ করার চেষ্টা করা হয় । কিন্তু ৬ দিন হলেও ভগবানের শরীর একটুকুও পুড়লো না । তখন দৈববাণী হোলো- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই নশ্বর দেহ আগুনে দাহ করা যাবে না। এই পবিত্র দেহ সমুদ্রে বিসর্জন দাও।” ঠিক সেই মতো সমুদ্রে বিসর্জিত করা হলে সেই দেহ কাষ্ঠে রূপান্তরিত হয়ে ভাসতে ভাসতে এলো । সেই কাষ্ঠ রোহিনীকুণ্ডে পাওয়া যায়। সেই কাষ্ঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরী হোলো ।ওড়িশা ভারতের এক প্রাচীন রাজ্য। এখানকার সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেক পুরানো । জগন্নাথ যেমন বৈষ্ণব দের নিকট বিষ্ণু তেমনি শাক্ত ও শৈবদের নিকট ভৈরব শিব । যে যেমন ভাবে দেখতে চায়- জগন্নাথ তাঁর কাছে সেরূপেই প্রকাশিত হন। হরিহর অভেদ তত্ত্ব এই শ্রীক্ষেত্রে দেখা যায় । ওড়িশার নানা অঞ্চল জুড়ে বহু প্রাচীন মন্দির আছে । এগুলোর সবকটি সম্বন্ধে লেখা অসম্ভব । কি শিব মন্দির, কি শক্তিপীঠ, কি গোপাল মন্দির এমনকি বৌদ্ধ ও জৈণ ধর্মের নিদর্শন ওড়িশা রাজ্য জুড়ে দেখা যায় । আসুন জেনে নেই পুরীধামে কি কি দেখবার প্রধান জায়গা আছে । জগন্নাথ মন্দির দর্শন সেড়ে “মার্কণ্ডেয় পুষ্করিণী” পুরান গুলি বিশেষত স্কন্দপুরাণে লেখা আছে ভগবান হরির নির্দেশে মার্কণ্ড মুনি এই পুষ্করিণী খনন করেছিলেন , এখানে অনেক ঘাট, শিব মন্দির অষ্ট মাতৃকা মন্দির আছে । এবার দর্শনীয় স্থান ইন্দ্রদুম্ন্য সরোবর । মহারাজ ইন্দ্রদুম্ন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সময় ব্রাহ্মণ দের যে গাভী দান করেছিলেন সেই গাভীগুলির ক্ষুরের আঘাতে এই পুষ্করিণী সৃষ্টি হয় ও গোমূত্র, জলে পুষ্করিণী ভরাট হয় । এই জলের দ্বারা মহাপ্রভু তাঁর পার্ষদ সহিত গুণ্ডিচা মন্দির মার্জন করতেন । এরপর “মহাদধি সমুদ্র” । পুরাণ মতে মা লক্ষ্মীর আবির্ভাব সমুদ্র মন্থন থেকে হয়েছিলো। বলা হয় এইস্থানে মা লক্ষ্মী প্রকট হয়েছিলেন । জগন্নাথের স্ত্রী লক্ষ্মী দেবীর আবির্ভাব এইস্থানে হওয়ায় ওড়িশা বাসী হাস্যচ্ছলে এইস্থান কে জগন্নাথের শ্বশুর গৃহ বলেন । এই স্থানেই মহাপ্রভু পরম ভক্ত হরিদাস ঠাকুরকে সমাধিস্থ করেন বালি দিয়ে ।
    এরপর “নরেন্দ্র পুষ্করিণী” । এটিকে জগন্নাথ দেবের পিসির বাড়ী বলা হয় । পিসি হলেন কুন্তী । মহাভারতে কিছু স্থানে দেখা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুন্তীদেবীকে ‘পিসি’ সম্বোধন করতেন । এখানে জগন্নাথ দেব এসে মালপোয়া সেবা নেন। এখানেই প্রভুর চন্দনযাত্রা হয় । তারপর আছে “শ্বেতগঙ্গা” বলা হয় এখানে মা গঙ্গা অবস্থান করেন। এখানে স্নানে গঙ্গা স্নানের ফল পাওয়া যায় । এখানে ভগবান মৎস্য ও মা গঙ্গার মন্দির আছে । এরপর স্বর্গদ্বার সমুদ্র তট । অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত সমুদ্র তট । সমুদ্র চরে বসে আপনার মন কোনো এক মধুমাখা কল্পনা লোকে চলে যাবে, হোটেলের বেলকোণি থেকে এই সমুদ্র তরঙ্গ দেখতে দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় যেনো কেটে যায়, বিরক্ত আসে না ।
    এছাড়া সার্বভৌম আচার্যের বাড়ী, গম্ভীরা গুলি দর্শনীয় স্থান । এছাড়া আরোও অনেক বহু প্রাচীন মন্দির বিরাজিত । জগন্নাথ ক্ষেত্র বা ওড়িশা বা ঔড্র দেশ বা নীলাচল ধাম অপূর্ব সুন্দর ক্ষেত্র । জয় জগন্নাথ ।
    ( সমাপ্ত )
    লেখাটি ডঃ সুমন গুপ্তের লেখা “জগন্নাথ দেবের অমৃত কথা” বইটি থেকে নেওয়া ।

    আংকর ওয়ত

    আঙ্করভাট মন্দির

    কম্বোডিয়ার হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির

    Angkor Wat.jpg

    আঙ্করভাট (অর্থাৎ “শহরের মন্দির“, “আংকর” হল সংস্কৃত “নগর” শব্দের স্থানীয় উচ্চারণ) কম্বোডিয়ার আংকরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মন্দির। সুবিশাল এই স্থাপনাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির।আঙ্করভাটধর্মঅন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্মঅবস্থানঅবস্থানআংকর, সিয়াম রিপ প্রদেশ, কম্বোডিয়াদেশকম্বোডিয়াস্থাপত্যধরনখমের, দ্রাবিড়সৃষ্টিকারীসূর্যবর্মণ ২/সমুদ্রগুপ্ত

    ১২শ শতাব্দীতে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা ২য় সূর্যবর্মণ। তিনি এটিকে তার রাজধানী ও প্রধান উপাসনালয় হিসাবে তৈরি করেন। তখন থেকেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসাবে বিবেচিত। প্রথমদিকে হিন্দু মন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হলেও পরে এটি বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়।

    আঙ্করভাটের নির্মাণশৈলী খ্‌মের সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পকলার অণুপম নিদর্শন। এটি কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় স্থান পেয়েছে, এবং দেশটির প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।

    আঙ্করভাটে খ্‌মের মন্দির নির্মাণ কৌশলের দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে – টেম্পল মাউন্টেন বা পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ, ও গ্যালারি মন্দির ধাঁচ। এটি হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীদের বাসস্থান মেরু পর্বতের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চারদিকে রয়েছে পরিখা ও ৩.৬ কিমি দীর্ঘ প্রাচীর। ভিতরে ৩টি আয়তাকার গ্যালারি বা বেদি আকৃতির উঁচু এলাকা রয়েছে। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে স্তম্ভাকৃতির স্থাপনা। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে পার্থক্য হল – এটির সম্মুখ ভাগ পশ্চিমমুখী। মন্দিরটির বিশালত্ব, সৌন্দর্য ছাড়াও এর দেয়ালের কারুকার্যের জন্য এটি সারা বিশ্বে পরিচিত।

    ইতিহাসসম্পাদনা

    আংকর ওয়ত আংকরের পূরাকীর্তিসমূহের মধ্যে সর্বদক্ষিণে অবস্থিত

    আঙ্করভাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১২শ শতাব্দীর প্রথমভাগে, রাজা ২য় সূর্যবর্মণের রাজত্বকালে (১১১৩-১১৫০)। মন্দিরটির আরাধ্যদেবতা ছিল বিষ্ণু। এটি সূর্যবর্মণের মূল মন্দির ও রাজধানী হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। তবে মন্দিরের স্থাপনার সময়কার কোন লেখা বা সমসাময়িক কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় নাই বলে মন্দিরটির আদি নাম কী ছিল, তা অজ্ঞাত।

    মন্দিরটি বর্তমানকালের সিয়েম রিপ শহরের ৫.৫ কিমি. উত্তরে, এবং প্রাচীন রাজধানী শহর বাফুওন এর সামান্য দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। রাজা সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর এর নির্মাণ কার্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এর দেয়ালের কিছু কারূকার্য অসমাপ্ত থেকে যায়।[১] ১১৭৭ সালে আংকর শহরটি খ্‌মেরদের চিরাচরিত শত্রু চামদের হাতে পরাজিত ও লুণ্ঠিত হয়। এর পরে নতুন রাজা ৭ম জয়বর্মণ রাজ্যটিকে পূনর্গঠিত করেন। তিনি আঙ্করভাটের কয়েক কিমি উত্তরে আংকর থোম-এ নতুন রাজধানী ও বায়ুন নগরে প্রধান মন্দির স্থাপন করেন। .

    ১৮৬৬ সালে এমিল জ্‌সেল এর তোলা আংকর ওয়তের আলোকচিত্র।

    রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কম্বোডিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। ফলে ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দীতে আঙ্করভাট বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে এর আরেকটি পার্থক্য হল – যদিও ১৬শ শতাব্দীর পরে এটি কিছুটা অবহেলিত হয়, তথাপি অন্যান্য মন্দিরের মতো এটি কখনোই পরিত্যক্ত হয় নাই। চারদিকে পরিখা থাকায় বন জঙ্গলের গ্রাস থেকে মন্দিরটি রক্ষা পায়। [২] এসময় মন্দিরটি সূর্যবর্মণের মরণোত্তর উপাধি অনুসারে প্রিয়াহ পিস্নুলোক নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক নামটি, অর্থাৎ আঙ্করভাট নামটির ব্যবহার ১৬শ শতাব্দী হতে শুরু হয়। [৩] এই নামটির অর্থ হল নগর মন্দির। আংকর শব্দটি এসেছে নগর শব্দ হতে, যা আসলে সংস্কৃত শব্দ নগর এর অপভ্রংশ। আর ওয়ত হল খ্‌মের ভাষার শব্দ যার অর্থ মন্দির।

    পশ্চিমা পরিব্রাজকদের মধ্যে এই মন্দিরে প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক আন্তোনিও দা মাগদালেনার। তিনি ১৫৮৬ সালে প্রথম এই মন্দির এলাকা ভ্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন, এটি (মন্দিরটি) এমন অসাধারণ ভাবে নির্মিত যে, ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারা বিশ্বে এরকম আর কোন ভবন বা স্থাপনার অস্তিত্ব নাই। এখানে রয়েছে খিলান ও অন্যান্য কারুকার্য, মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সেরা সৃষ্টি। [৪] তবে পাশ্চাত্যে এই মন্দিরের কথা ছড়িয়ে পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি অভিযাত্রী অনরি মৌহত এর ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন,

    এই মন্দিরগুলির মধ্যে একটি (আঙ্করভাট), সলোমনের মন্দিরকেও হার মানায়। মাইকেলেঞ্জেলোর মতোই কোন প্রাচীন শিল্পী এটি নির্মাণ করেছেন। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর ভবন সমূহের সাথে এটি সমতূল্য। এটি এমনকী প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমের স্থাপনা গুলির চাইতেও অনেক বেশি রাজকীয়, সুন্দর। বর্তমানে এই দেশটি (কম্বোডিয়া এলাকা) যে বর্বরতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, তার সাথে এই মন্দিরের বিশালতার ও সৌন্দর্যের এক বিশাল ফারাক রয়েছে।[৫]

    কম্বোডিয়ার পতাকায় আংকর ওয়ত প্রদর্শিত হয়েছে।

    অন্যান্য পাশ্চাত্যের পরিব্রাজকদের মত মৌহতও বিশ্বাস করতে পারেন নাই যে, খ্‌মেররাই এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। তিনি ভুলক্রমে ধারণা করেন, মন্দিরটি রোম সাম্রাজ্যের সমসাময়িক। আঙ্করভাটের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটিত হয় এখানকার স্থাপত্যশৈলী ও শিলালিপি হতে, যা মন্দিরের সমস্ত এলাকা পরিষ্কার করার পরে প্রকাশ পায়।

    বিংশ শতাব্দীতে আঙ্করভাটের ব্যাপক সংস্কার সম্পন্ন হয়। এ সময় প্রধানত এর চারিদিকে গ্রাস করে নেয়া মাটি ও জঙ্গল সাফ করা হয়।[৬] গৃহযুদ্ধ ও খ্‌মের রুজ শাসনকালে ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকগুলিতে সংস্কার কার্য বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আঙ্করভাট এলাকায় পরে স্থাপিত মূর্তিগুলি চুরি যাওয়া ও ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া মূল মন্দিরের খুব একটা ক্ষতি এসময় হয় নাই। [৭]

    বর্তমানে আঙ্করভাটের মন্দিরটি কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটি দেশবাসীর গৌরব। ১৮৬৩ সালে প্রথম প্রবর্তনের পর থেকে কম্বোডিয়ার সব পতাকাতেই আঙ্করভাটের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। [৮] সারা বিশ্বে এটিই একমাত্র ভবন যা কোন দেশের পতাকায় প্রদর্শিত হয়েছে।[৯]

    স্থাপত্যশৈলীসম্পাদনা

    Devatas are characteristic of the Angkor Wat style.

    আংকর ওয়তে মন্দিরটি খ্‌মের স্থাপত্যের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। পরবর্তীতে এধরনের স্থাপত্য কলাকে আংকর ওয়ত রীতি নাম দেয়া হয়। ১২শ শতক নাগাদ খ্‌মের স্থপতিরা ইটের বদলে স্যান্ডস্টোন (বা পাথর) ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেন। আংকর ওয়তের রীতির পরে শুরু হয় বায়ুন পর্ব, যখন সৌন্দর্যের চাইতে বিশাল আকারের স্থাপনা গড়াকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। [১০] এই সময়ের অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে রয়েছে বান্তাই সাম্রেথোম্মাননচাও সে তাভোদা এবং আংকর এর প্রিয়া পিথুর আদি মন্দির গুলি। আংকরের বাইরে বেং মিয়ালিয়া, এবং ফানম রুং ও ফিমাই এর মন্দির গুলি এই ধাঁচ অণুসরণ করেছে।

    আংকর ওয়তের মন্দিরটি এর স্থাপত্যকলার সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসিত। এর সাথে প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমের স্থাপত্য কলার তুলনা করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আংকরের সংরক্ষণকারী মরিস গ্লেইজের মতে, “It attains a classic perfection by the restrained monumentality of its finely balanced elements and the precise arrangement of its proportions. It is a work of power, unity and style.” [১১]

    মন্দির এলাকাসম্পাদনা

    আংকর ওয়তের মন্দির এলাকার মানচিত্র

    আংকর ওয়ত মন্দিরের অবস্থান হল ১৩°২৪′৪৯″ উত্তর ১০৩°৫২′৯″ পূর্ব। এটি কম্বোডীয় স্থাপত্য, কম্বোডীয় রাজকীয় মন্দিরের প্রথাগত গড়ন, এবং এককেন্দ্রীক গ্যালারি রীতির সংমিশ্রন। এটি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের আবাস মেরু পর্বতের আদলে গড়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ৫টি টাওয়ার মেরু পর্বতের ৫টি পর্বত শৃঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করছে। দেয়াল ও পরিখা হল পর্বতমালা ও মহাসাগরের প্রতীক।.[১২] মন্দিরের উচ্চতর অংশগুলিতে প্রবেশ ক্রমশ দুরুহ হয়েছে। সাধারণ জনতাকে কেবল মন্দিরের নিচের অংশেই প্রবেশ করতে দেয়া হত।.[১৩]

    অন্যান্য খ্‌মের মন্দির যেখানে পূর্ব দিকে মুখ করে নির্মিত হয়েছে, সেখানে আংকর ওয়তের মন্দিরটি একটি ব্যতিক্রম। এটি পশ্চিম দিকে মুখ করে নির্মিত। অনেকের মতে (মরিস গ্লেইজ ও জর্জ কোয়েদেস সহ) এর কারণ হল, এটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যবহার করা হত। এর আরো প্রমাণ হল, এর দেয়ালের কারুকার্য, যেখানে নকশাগুলি ঘড়ির কাঁটার উল্টা দিকে করে বসানো আছে। হিন্দু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে এভাবে উল্টা ক্রমে কাজ করা হয়। [৬] পুরাতত্ত্ববিদ চার্লস হিগাম এখানকার কেন্দ্রীয় টাওয়ারে একটি কলসী জাতীয় বস্তু পেয়েছেন, যা সম্ভবত অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় চিতাভস্ম রাখার জন্য ব্যবহার করা হত।.[১৪] তবে ফ্রিম্যান ও জাঁকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আংকরের আরো কিছু মন্দির এরকম পশ্চিম মুখী করে বানানো, তাদের মতে আংকর ওয়তের পশ্চিমমুখিতার কারণ হল এটি বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির। উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, বিষ্ণু দেবতা পশ্চিম দিকের সাথে জড়িত।

    এলেনর মান্নিক্কা মন্দিরটির সম্পর্কে আরেকটি ধারণা প্রদান করেছেন। মন্দিরের অবস্থান ও আকৃতির ভিত্তিতে এবং চিত্রাবলীর বিষয় ও বিন্যাসের কারণে তার ধারণা, এটি রাজা ২য় সুর্যবর্মণের শাসনামলের দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পরিচায়ক।[১] এই ধারণাটি অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে সর্বাঙ্গীনভাবে গৃহীত হয় নাই। [১৪] গ্রাহাম হ্যানককের মতে আংকর ওয়ত হলো দ্রাকো নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতীক। [১৫]

    বাইরের অঙ্গনসম্পাদনা

    ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আংকর ওয়তের মডেল। এতে নিম্নের অর্ধ-গ্যালারি ও দ্বিতীয় তলার গ্যালারির কোনায় দন্ডায়মান টাওয়ার দেখা যাচ্ছে।

    মূল মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার, নাগা পথের পূর্ব সীমা হতে তোলা ছবি

    বাইরের দেয়ালটি দৈর্ঘ্যে ১০২৫ মিটার, প্রস্থে ৮০২ মিটার, এবং উচ্চতায় ৪.৫ মিটার। এর চার দিকে ৩০ মিটার দূরত্বে ১৯০ মিটার চওড়া একটি পরিখা আছে। মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য পূর্ব দিকে একটি মাটির পাড় এবং পশ্চিম দিকে একটি বেলেপাথরের পুল রয়েছে। এই পুলটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার, এবং মন্দির নির্মাণের অনেক পরে যোগ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এর স্থানে পূর্বে একটি কাঠের পুল ছিলো। [১৬]

    কেন্দ্রের স্থাপনাসম্পাদনা

    মূল মন্দিরটি শহরের অন্যান্য স্থাপনা হতে উঁচুতে অবস্থিত। এতে রয়েছে তিনটি পর্যায়ক্রমে উচ্চতর চতুষ্কোণ গ্যালারি, যা শেষ হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ারে। মান্নিকার মতে এই গ্যালারিগুলো যথাক্রমে রাজা, ব্রহ্মা, এবং বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।[১] প্রতিটি গ্যালারির মূল (কার্ডিনাল) বিন্দুগুলোতে একটি করে গোপুরা রয়েছে। ভিতরের দিকের গ্যালারিগুলোর কোণায় রয়েছে টাওয়ার। কেন্দ্রের টাওয়ার এবং চার কোনের চারটি টাওয়ার মিলে পঞ্চবিন্দু নকশা সৃষ্টি করেছে।

    বর্তমান অবস্থাসম্পাদনা

    বহিঃপ্রাচীরের ভিতর হতে মন্দিরের উত্তর পশ্চিম দিকের দৃশ্য

    ১৯৯০ এর দশক হতে আংকর ওয়তের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এর সাথে সাথে শুরু হয় পর্যটনশিল্প। ভারতের পুরাতাত্তিক সংস্থা ১৯৮৬ হতে ১৯৯২ সালের মধ্যে মন্দিরটিতে সংস্কারের কাজ করে। [১৭] মন্দিরটি আংকরের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯২ সালে স্বীকৃত হয়। এতে করে মন্দিরের সংস্কারের জন্য অর্থায়ন ও কম্বোডিয়া সরকারের দ্বারা মন্দিরের সুরক্ষার কার্যক্রম সহজতর হয়েছে। [১৮] জার্মানির অপ্সরা সংরক্ষণ প্রকল্প এই মন্দিরের অপ্সরা ও দেবতাদের ছবি সংবলিত কারুকার্যমন্ডিত দেয়ালের নকশাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। সংস্থাটির সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রাকৃতিকভাবেই পাথর ক্ষয়ে যাওয়ায় দেবতামূর্তিগুলির ২০ শতাংশেরই খুব করুণ দশা। তার উপরে শুরুর দিকের সংরক্ষণকারীদের অনভিজ্ঞতার ফলেও অনেক ক্ষতি হয়েছে।[১৯] সংস্কার কার্যের অন্যান্য দিকের মধ্যে রয়েছে ধ্সে যাওয়া অংশ মেরামত। যেমন, উপরের স্তরের পশ্চিম দিকের ২০০২ সাল থেকেই খুঁটি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।[২০] জাপানি বিশেষজ্ঞ্ররা ২০০৫ সালে উত্তর দিকের পাঠাগার মেরামত করেছেন। [২১]

    ২০০৪ সালে কম্বোডিয়াতে মোট পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি,[২২] যার অন্তত ৫৭% আংকর ওয়তে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন।.[২৩] পর্যটকদের আনাগোনার ফলে অল্প কিছু দেয়াল লিখন ছাড়া মন্দির এলাকার খুব ক্ষতি হয় নাই। মন্দিরের কারুকার্যকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পর্যটনশিল্পে লদ্ধ আয়ের ২৮% মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহার করা হয়। [২৪]

    জগন্নাথের রথের রশি স্পর্শের এত আকুলতা কেন?

    জগন্নাথের রথের রশি স্পর্শের এত আকুলতা কেন?

    রথের রশির নাম বাসুকি। জগন্নাথদেবের রথের রশি একটি বার স্পর্শ করার জন্য আকুল হয়ে পড়েন ভক্তরা। পুরী, কলকাতার রথ কিংবা বিশ্বব্যাপী রথ, সর্বত্রই রথের রশি ছুঁয়ে দেখার জন্য মানুষের ভিড় উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়। আসলে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, জগন্নাথদেবের রথের রশি স্পর্শ করলে পুনর্জন্মের কষ্ট সহ্য করতে হয় না।

    এক সময় পুুরীর রথযাত্রায় জগন্নাথদেবের রশি ছুঁয়ে সেই রথের চাকার তলায় আত্মঘাতী হতেন কোনও কোনও ভক্ত।

    কেন এই অদ্ভূত মৃৃত্যুবরণ? মানুষের বিশ্বাস, শ্রীপুরুষোত্তমের চাকার নীচে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গারোহণ নিশ্চিত করা যায়।

    শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য সনাতন গোস্বামী অসুস্থতার কারণে একবার রথযাত্রার দিন জগন্নাথদেবের চলন্ত চাকার তলে প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন। তখন মহাপ্রভুই তাঁকে বলেন, সনাতন, এরকম দেহ ত্যাগে যদি কৃৃষ্ণকে পাওয়া যেত, তাহলে এক মূহূর্তের মধ্যে আমিও আমার লক্ষ জন্ম তাঁর শ্রীচরণে সমর্পণ করতাম। কিন্তু দেহত্যাগে কৃৃষ্ণকে পাওয়া যায় না। এরকম দেহত্যাগ হচ্ছে তমোগুণ। তমোগুণে কৃৃষ্ণকে পাওয়া যাবে না। ভক্তি ছাড়া, ভজন ছাড়া তাঁকে পাওয়ার উপায় নেই।

    ইন্দ্রনীলময় পুুরাণের মতে, “জগন্নাথের রথের রশি সামান্য স্পর্শ করলেও পুনর্জন্ম হয় না। পুনর্জন্ম ন ভূঞতে।”

    শ্রীজগন্নাথের বামন অবতার রথ। সেই রথ দর্শন করার পর একটু টানতে পারলেই পুনর্জন্ম হয় না। সূতসংহিতায় রয়েছে, “রথে তু বামনাং দৃৃষ্টা, পুনর্জন্ম ন বিদতে। অতএব ধার্মিক সনাতনী বিশ্বাস করেন যে, রথের রশি ছোঁয়ার থেকে বড় পূর্ণ আর কিছুতে হয় না।”

    রথযাত্রা নিয়ে কপিল সংহিতায় আছে, “গুন্ডিচাখ্যং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি মুদনিতাঃ সর্বপাপ বিনির্মুক্তা তে যান্তি ভুবন মম।’ অর্থাৎ জগন্নাথদেব বলছেন, গুন্ডিচা মহাযাত্রায় যে ব্যক্তি আমাকে দর্শন করবে, সে কালক্রমে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমার ভুুবনে যাবে।(সংগৃহীত)

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩৯””

    আজকের লীলাঃ “জগন্নাথ স্নানযাত্রা মহোৎসব”

    ## জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা মহোৎসব
    ভগবান জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব তিথিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ দেবের এক বিশেষ স্নান যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
    শাস্ত্রে আছে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ভগবান মাথায় খুব যন্ত্রনা অনুভব করেন। তার মাথার সেই যন্ত্রনা উপশম করার জন্য ভক্তগন তার গায়ে চন্দন লেপে দেন। আজ স্নানের মাধ্যমে সেই চন্দন ধুয়ে ফেলা হবে।
    >স্কন্ধ পুরাণ অনুসারে রাজা ইন্দ্রদুম্ন যখন জগন্নাথ দেবের কাঠের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন তখন থেকে এই স্নান যাত্রার উৎসব শুরু। স্নান যাত্রার দিনটিকে জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব তিথি বা জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়। স্নান যাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবী এবং সুদর্শন দেবকে বেদী থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি করা স্নান বেদীতে নিয়ে আসা হয়। পুরীর মন্দির প্রাঙ্গনে বিশেষ ভাবে তৈরি করা এই মণ্ডপকে বলা হয় স্নান মণ্ডপ। এটা এত উঁচু যে মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে থেকেও বেদিতে উপবিষ্ট বিগ্রহ সমূহ অবলোকন করা যায়।
    অনুষ্ঠানের দিন স্নান মণ্ডপকে ঐতিহ্যবাহী ফুল, বাগান ও গাছের চিত্রকল্প দ্বারা সজ্জিত করা হয়। তোরণ এবং পতাকা দ্বারা সজ্জিত করা হয়। জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এর পর বিগ্রহের উদ্দশ্যে ধুপ, ধুনা অর্পণ করা হয়।
    পুরীতে স্নানের জন্য সোনার তৈরি এক ধরনের কুয়া থেকে জল আনা হয়। জল আনার সময় পুরোহিতরা তাদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন যাতে জল তাদের মুখনিঃসৃত কোন কিছু দ্বারা এমনকি তাদের নিঃশ্বাস দ্বারা দূষিত না হয়।
    স্নান মহোৎসবের পূর্বে জগন্নাথ,বলরাম এবং সুভদ্রা দেবীকে সিল্কের কাপড় দ্বারা আবৃত করা হয় এবং তারপর লাল এক ধরনের পাউডার দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। ১০৮ টি স্বর্ণ পাত্র জল দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই জল দ্বারা অভিষেক করা হয়। অভিষেকের সময় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ,কীর্তন এবং শঙ্খ বাজানো হয়।
    এরপর জগন্নাথ দেব এবং বলরাম দেবকে হাতি বেশে সাজানো হয়। এই সময় সুভদ্রা দেবীকে পদ্ম সাজে সাজানো হয়। স্নান যাত্রা উৎসবের পর ১৫ দিন ভগবানকে জনসাধারণ থেকে দূরে রাখা হয়। এই ১৫ দিন মন্দিরে কোন অনুষ্ঠান করা নিষেধ। এই সময় ভগবান জগন্নাথ , বলরাম এবং সুভদ্রা দেবীকে রতন বেদী নামে এক বিশেষ বেদীতে রাখা হয়। এই সময়কে বলা হয় অনাবাসর কাল মানে পূজা করার জন্য অযোগ্য সময়। স্নান করানোর ফলে বিগ্রহ সমূহ বিবর্ণ হয়ে যায়। এই ১৫ দিনে জগন্নাথ দেবকে আগের সাজে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৬ তম দিনে জগন্নাথ দেবকে আবার সবার দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
    রথ যাত্রার ১৬দিন পূর্বের পূর্ণিমায় ভগবান জগন্নাথদেবকে স্নান করানো হয়। তারপর ভগবান ১৪দিন অসুস্থ লীলা করেন। একে বলা হয় প্রভুর অনবসর লীলা। এই দিন থেকে ভগবান রথ যাত্রার আগ পর্যন্ত মন্দিরে ভক্তদের দর্শন দান করেন না। এইসময় মন্দিরে জগন্নাথের চিত্রপট দর্শন হয়।
    পুরাণের মতে, ব্রহ্মার পুত্র স্বয়ম্ভুব মনু পৃথিবীতে ভগবানকে দর্শন করবার জন্য একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন, সেই যজ্ঞের প্রভাবে জগন্নাথদেবের আগমন ঘটে। সেই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথি। সেইজন্য এইদিনটিকে বলা হয় জগন্নাথদেবের আবির্ভাব তিথি। এই তিথিতে আবির্ভূত হয়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব স্বয়ম্ভুব মনুকে বলেন যে উপস্থিত ভক্তগন যেন সবাই মিলে পবিত্র জলে শ্রীজগন্নাথদেবকে স্নান করান। ওইদিন ভগবানকে স্নান করিয়ে ভক্তগন বহু প্রকার কল্যান লাভ করেন। এই জন্য এই স্নানদিবসে সুসজ্জিত স্নানবেদীতে জগন্নাথকে মহাসমারোহে স্নান করানো হয়ে থাকে।
    অন্য পুরান কথায় বলা হয় যে, বহু পূর্বে ইন্দ্র দ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা মালবদেশের অবন্তীনগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি ভগবান জগন্নাথ বা নীলমাধবের দর্শনের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। বহু চেষ্টার পর ভগবানকে খুঁজে পেলে এই তিথিতে তিনি ভগবানের বিগ্রহ মন্দিরে স্থাপন করেন। সেই উপলক্ষ্যে মঙ্গল অধিবাস পুরঃসর মহাসমারোহে পুরীর ইন্দ্র দ্যুম্ন সরবোরে দিব্য স্নানবেদীর ওপর তিনি ১০৮ কলস জলে জগন্নাথদেবের মহাভিষেক পুণ্য স্নানসেবা সম্পাদন করেন ।
    লক্ষণীয় বিষয় এই যে এই তিথিতে কেবল জগন্নাথ নয়, অন্য সনাতন দেব দেবীকেও ভারতের বিভিন্ন দেবস্থানে স্নান করানো হয়।
    জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসবসনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র উৎসব। এই স্নানযাত্রা উৎসবে শুধু জগন্নাথদেবই স্নান করেন না; তার সঙ্গে স্নানে অংশগ্রহণ করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। পুণ্যার্থীদের ধারণা, অতীতের সব পাপ থেকে মুক্তি মেলে এই স্নানযাত্রা উৎসবে অংশগ্রহণ করে। শুধু যে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাই নয়, অশেষ পুণ্যও লাভ হয়।
    স্নানের পর জগন্নাথদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন পুরীর রাজার রাজবৈদ্যের চিকিৎসাধীনে একটি পৃথক কক্ষে সাধারণের চক্ষুর আড়ালে রাখা হয়। কথিত হয়, এক পক্ষকালের মধ্যে রাজবৈদ্যের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় জগন্নাথ পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তারপর থেকে আবার ভক্তদের দর্শন দানের মাধ্যমে রথযাত্রা মহোৎসব উৎযাপন করেন –

    ‘শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩৮ “”

    আজকের লীলাঃ “”জগন্নাথ ও শরণাগত জেলে”” –

    ## জগন্নাথ ও শরণাগত জেলে-

    জগন্নাথ পুরী থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে পিপলি নামে একটি গ্রাম ছিল যেখানে একসময় রঘুবেহারা নামে একজন জেলে তার মা ও অনুগত স্ত্রীকে নিয়ে পারিবারিক জীবনযাপন করত। এইভাবে জীবন অতিবাহিত করতে করতে একবার সাধুসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবত শোনার সুযোগ হল। সাধুদের সঙ্গ প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মালাও গ্রহণ করলেন এবং ভগবানের দিব্যনাম জপকীর্তন করতে শুরু করলেন। নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করার পর তিনি উপলব্ধি করলেন এই মৎস্য হত্যা কত পাপময় কর্ম। তার ওই মাছধরা পেশার কথা ভেবে তিনি খুব লজ্জিত হলেন কিন্তু সেটাই ছিল তার জীবিকা নির্বাহের উপায়। তিনি তার দৃষ্টকে দোষারোপ করতে লাগলেন যে তার দুর্ভাগ্যক্রমে জেলের ঘরে জন্ম হয়েছে, এবং এই ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন হলেন যে তাকে এই জীবহত্যা রুপ পাপ কর্মের জন্য নরকে যেতে হবে।
    এই কথা বিবেচনা করে তিনি মাছ ধরা বন্ধ করে দিলেন। যেহেতু তিনি দরিদ্র ছিলেন তাই তার পরিবার প্রতিপালনের জন্য আর কিছুই ছিল না। তার মাতা ও স্ত্রী তাকে এই বলে ভৎর্সণা করতে লাগল,“তুমি যদি সাধু হয়ে যাও এবং রোজগার উপার্জন বন্ধ করে দাও, তাহলে আমরা অনাহারে থাকতে বাধ্য হব। তার চেয়ে ভাল তুমি তোমার এই পেশাগত মাছ ধরার কর্ম কর তোমার পরিবার প্রতিপালনের জন্য।”
    একথা শুনে রঘুবেহারা রাগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং মানসিকভাবে খুব বিচলিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার জালটি নিয়ে মাছ ধরতে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণকে স্বরণ করে তিনি জলে জাল ফেলেন এবং জালে একটি খুব বড় মাছ ধরা পরল। রঘু তখন মনে মনে চিন্তা করলেন,“আমি কেমন করে এই মাছটিকে হত্যা করব! মৎস্যাবতারে প্রভু সংখ্যাসুর নামক রাক্ষসকে হত্যা করেছিলেন। এই মাছ ভগবানের অপ্রাকৃত রুপেরই অনুরুপ, কিন্তু আমি যদি এই মাছটিকে হত্যা না করি তাহলে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করতে পারব না। আমার স্ত্রী আমাকে পদাঘাত করে আমার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে এবং আমাকে আর খেতে দিবে না।”
    এই রকম চিন্তা করে তিনি কাদতে শুরু করলেন এবং মাছটিকে মাটিতে রেখে সেই মাছটিকে বললেন,“হে মৎস্যরুপী ভগবান! দয়া করে শোন। তুমি আমাকে একটি জেলের ঘরে জন্ম দিয়েছ, আমার কর্তব্য হচ্ছে তোমাকে নিধন করা, কিভাবে আমি সেই পেশা ত্যাগ করব? আমি যদি তোমাকে হত্যা না করি তাহলে আমি কিছু আহার করতে পারব না।” রঘু তখন মাছটির গলা টিপে মাছটিকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। যখন তিনি এইভাবে মাছটিকে চেপে ধরেছিলেন তখন মাছটি কাদতে কাদতে নারায়ণের নাম উচ্চারণ করে বলল,“হে নারায়ন! দয়া করে আমাকে রক্ষা কর!”
    মাছটিকে কথা বলতে দেখে রঘু অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। একটি মাছের মুখ থেকে নারায়ণের পবিত্র নাম শ্রবণ করে তিনি খুব খুশি হলেন। মহানন্দে তিনি মাছটিকে উপরে তুললেন এবং বনে গেলেন। সেই জঙ্গলে তিনি একটি নদী দেখতে পেলেন, সেখানে তিনি তার কাছাকাছি একটি গর্ত করলেন, তারপর সেই ছোট নদী থেকে জল নিয়ে সেই গর্তটি ভরলেন এবং সেই গর্তের মধ্যে মাছটিকে ছেড়ে দিলেন। তিনি তখন মাছটির পাশে বসলেন এবং এই রকম ইচ্ছা প্রকাশ করলেন,“এই মাছ যার দিব্যনাম উচ্চারণ করছে, সেই নারায়ণকে আমি দেখতে চাই। যদি সেই নারায়ণ আমাকে তার দর্শন না দেন তাহলে আমি এই দেহ ত্যাগ করব।” এই রকম প্রতিঙ্গা করে রঘু দৃড় সংকল্প নিয়ে সেখানেই থেকে গেলেন। সর্বেন্দ্রিয় সংযম করে তিনি ভগবানের দিব্যনাম জপ করতে লাগলেন। সেখানে এভাবে তিনি তিনদিন অতিবাহিত করলেন এবং নিরন্তর তিনি ভগবানের দিব্যনাম জপ করতে করতে প্রেমানন্দে বিভোর ছিলেন। তিনি এতটাই দিব্যানন্দে মত্ত ছিলেন যে তিনি বুঝতে পারেননি কিভাবে এই তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। শ্রীনারায়ন তার ভক্তের দৃঢ় সংকল্প দেখে প্রীত হয়ে একজন বৃদ্ধ ব্রাক্ষণবেশে তার সামনে আবির্ভূত হলেন। ভগবান শ্রীনারায়ণ রঘুকে বললেন,“হে তপস্বী!কেন তুমি এধরণের তপস্যায় নিয়োজিত হয়েছে? তুমি কোন জাতি, কোন সম্প্রদায়ের মানুষ? তোমার কি বাস করার মতো কোন গৃহ নেই? এখানে একাকী বসে তুমি কী পরিকল্পনা করছ? আমাকে সবকিছু বল!”
    রঘু উত্তর দিলেন,“ আমি জাতিতে একজন জেলে। আমি আমার জীবিকা নির্বাহের জন্য মাছ ধরি। যখন আমি মাছটিকে ধরেছিলাম ও হত্যা করতে গিয়েছিলাম তখন এই মাছটি শ্রীনারায়ণ নাম উচ্চারণ করেছিল। বিস্মত হয়ে আমি এই মাছটিকে এখানে নিয়ে এসেছি এবং ভগবান শ্রীনারায়ণের দর্শন পাবার চেষ্টা করছি। যার দিব্য নাম এই মাছটি উচ্চারণ করেছিল, আমি কেবল সেই নারায়ণের দর্শন পাবার পরই গৃহে ফিরে যাবো। অন্যথায় এখানেই আমার দেহ ত্যাগ করব।”
    রঘু বললেন,“এখন আমি আমার মনের কথা তোমার কাছে ব্যক্ত করেছি। যতখন তুমি এখানে থাকবে আমার ভজনে বিঘ্ন ঘটবে। দয়া করে এই স্থান থেকে চলে যাও এবং আমাকে তার ভজন করতে দাও।” রঘু আবার নারায়ণের দিব্য নাম জপ করতে শুরু করলেন। রঘুর সামনে আবির্ভূত ব্রাহ্মনবেশী ভগবান তার মনের কথা বলতে পারে? আমি এটা বিশ্বাস করি না। যদি তুমি এই মাছটিকে কথা বলতে শুনে থাক, তাহলে এটি বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। তুমি কেমন করে চিন্তা করছ যে ভগবান তোমার দর্শন দেবেন? তুমি এখানে বৃথাই বসে আছ এবং অযথা এখানে তোমার মূল্যবান সময় অপব্যয় করছ। তার চেয়ে ভাল তুমি তোমার গৃহে ফিরে যাও এবং এই বৃথা তপস্যার কথা ভূলে যাও-যাতে কোনো ফল উৎপন্ন হবে না।
    এই ব্রাক্ষনের কথা শুনে রঘু খুব বিচলিত বোধ করলেন এবং বললেন,“হ্যাঁ,তুমি যা বলছ তা সত্যি হতে পারে। কিন্তু যতক্ষন না আমার শ্রীনারায়ন দর্শন দেবেন ততক্ষণ আমি আমার গৃহে ফিরে যেতে পারব না, আমি এই সিদ্ধান্তে অবিচলিত। হয় আমি প্রভুর দর্শন লাভ করব, নয় আমি আমার এ দেহ ত্যাগ করব। ইতিমধ্যেই আমি আমার জীবন তাকে উৎসর্গ করেছি। আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই। এই দারুব্রহ্ম জগন্নাথ দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেছেন অর্থাৎ তিনি দীনজনের সুহৃদ। তার মন্দিরে যে পতাকা উড়ছে, সেই পতাকার নাম হচ্ছে পতিতপাবন। তার হাতে যে চক্র রয়েছে তার ভক্তের কোন বিপদ হলে তাকে সাহায্য করার জন্য। তার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। আমি সম্পূর্ণভাবে তার উপর নির্ভরশীল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে তিনি অন্তত একবার তার ভক্তকে দর্শন দান করবেন। যদি তা না ঘটে তাহলে আমার এই দেহ ত্যাগ করাই সমীচিন হবে। যাইহোক, ব্রাক্ষণ, তোমার পাদপদ্মে আমার শতকোটি প্রণাম, কৃপা করে আমাকে তোমার আশির্বাদ প্রদান কর এবং তোমার আপন পথে এগিয়ে চল। অযথা খুব বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে; আমি আমার ভজন করে যেতে চাই।”
    রঘু বেহেরার কাছ থেকে এসব কথা শুনে বৃদ্ধ ব্রাক্ষণের ছদ্মবেশধারী শ্রীজগন্নাথ চিন্তা করলেন,“আমি যদি এখানে নিজেকে প্রকাশ না করি, কোন সন্দেহ নেই এই দরিদ্র জেলে ভক্তটি দেহ ত্যাগ করবে। তার নিজ জীবনের প্রতি আসক্তি নেই।”
    এই কথা ভেবে প্রভু রঘুকে বললেন,“আমি মাছের মুখ দিয়ে নারায়ন ধ্বনি তোমাকে শুনাতে চেয়েছিলাম। আমিই সেই নারায়ণ,জগদীশ্বর, আমি তোমাকে কৃপা করতে এসছি। তোমার যেমন অভিলাষ তেমনি কোন বর চাও।” অভিভূত হয়ে রঘুবেহারা বললেন,“আমি আর কি বর চাইব! আপনার অশেষ কৃপার ফলে আপনি স্বয়ং আমার সামনে এসেছেন। যদি আপনি আমার প্রভু হন তাহলে কৃপা করে আপনি আপনার স্বরুপ আমার কাছে প্রকাশ করুন। আপনার সেই অপ্রাকৃত রুপ দেখার জন্য আমার প্রবল অভিলাষ। আপনার সেই নারায়নরুপ দর্শন করে আমি জন্ম মৃত্যুর চক্রকে অতিক্রম করতে পারব।”
    তার ভক্তের নিকট থেকে এই কথা শ্রবণ করে তৎক্ষণাৎ শ্রীনারায়ন তার চতুর্ভুজ রুপে তার সামনে প্রকটিন হলেন। রঘু বিস্ময়ে আনন্দি হয়ে প্রভুর সেই শঙ্খা, চক্র, গদা,পদ্মধারী দিব্যরুপ দর্শন করলেন। পীতবস্ত্র পরিহিত অনিন্দ্যসুন্দর প্রভু তার খুবই দিব্য আকর্ষণীয় রুপে শোভা পাচ্ছিলেন। রঘু তৎক্ষণাৎ প্রভুর চরণকমলে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন,“হে প্রভু,আমি আর আপনার কাছ থেকে কি বর চাইব?আপনার চরণকমল শিব,ব্রহ্মা ও মহাদেবগণের দ্বারা পূজিত হন। সেই চরণকমল আজ আমার সামনে আবির্ভূত। এই হচ্ছে আপনার মহানুভবতা,উদারতা। আপনার যদি একান্তই কোন বরদানের অভিলাষ থাকে, তাহলে আমাকে এই কৃপা করুন যে আমাকে যেন পরিবার প্রতিপালনের জন্য জেলের কর্ম মৎস্য হত্যা করতে না হয়। আমি যেন আপনার দিব্য নাম করতে করতে এই দেহ ত্যাগ করি এবং যখনই আপনাকে স্বরণ করি তখনই যেন আপনাকে দেখতে পারি।” প্রভু শ্রীনারায়ন বললেন,“তথাস্ত,তুমি যা চাও তাই হবে।” এরপর প্রভু শ্রীনারায়ণ সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে বৈকুন্ঠে ফিরে গেলেন।
    রঘুবেহারা পরমান্দে গৃহে ফিরে এলেন। হাততালি দিয়ে প্রভুর দিব্যনাম করতে করতে তার নয়ন দিয়ে প্রেমাশু বিগলিত হতে লাগল। এদিকে তিনদিন ধরে যেহেতু রঘু গৃহে ফিরে আসেননি সেই জন্য তার পরিবারের সদস্যগণ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তারা কোন অশুভ সংবাদ শোনার আশঙ্কা করে কাদছিল, রঘু যখন গ্রামে ফিরে এলেন তারা ভাবল যে সে হয়ত উম্মাদ হয়ে গিয়েছে। “ তার এইসব নাম কৃর্তন ভন্ডামি, আসলে কাজ করার ভয়ে সে কোথাও লুকিয়েছিল। শিশু বয়স থেকেই সে খুব অলস। এখন সে গৃহে ফিরে এসেছে তার স্ত্রীকে ভয় দেখানোর জন্য”। এইরকম চিন্তা করে কিছু গ্রামবাসী তার বিদ্রুপ করতে লাগল। তার পরিবারের সদস্যগণ তাকে দেখলেন, তখন তার খুবই আনন্দিত হলেন। তারা রঘুকে গৃহে স্বাগত জানালেন এবং তাকে খেতে দিলেন, তার পর থেকে রঘু নারায়নের দিব্যনাম অণুক্ষণ কীর্তণ করতেন এবং মালা , তিলক পরতেন। যখন তিনি ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করতে করতে গ্রামের পথ দিয়ে যেতেন, গ্রামের লোকজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে চাল, ডাল, শাকসবজি এবং আরো অনেককিছু দিয়ে সাহার্য করত, যাতে সে তার পরিবার প্রতিপালন করতে পারে। এইভাবে তিনি সুখে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন।
    কিছুদিন পর রঘু গ্রামের মধ্যে একটি উচু স্থানে বসেছিলেন। কিছু বালক তাকে ঘিরে তার সম্বন্ধে নানা কটুক্তি করতে লাগল,“এই লোকটি তার নিজের কর্ম করে পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারে না। সেই জন্য ভন্ডামি করে সাধুর পোষাক পরেছে। এই ধরনের সাধুবেশ সে গ্রহণ করেছে যাতে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।” এইভাবে তারা তাকে বিদ্রুপ করছিল, উপহাস করছিল, গালাগালি দিচ্ছিল এবং তার দিকে নোংরা নিক্ষেপ করছিল। কেউ আবার তার জপমালাটি ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল। গ্রামের ছেলেদের এই রকম ব্যবহার দেখে রঘু গৃহে ফিরে আসছিলেন। একজন বালন তখনো তার পিছু পিছু অনুসরণ করে আসছিলেন এবং তাকে একটি কাঁটা গাছের ডাল দিয়ে তার উরুতে আঘাত করল। কাটা গাছের আঘাত পেয়ে রঘুর রক্তপাত হতে শুরু করল এবং তিনি বললেন,“আমি তোমাদের কাছে কি অপরাধ করেছি যে তোমরা আমাকে এইভাবে শাস্তি দিচ্ছ? ভগবান এর বিচার করুন। তোমার অবস্থা দেখে তোমার পিতা-মাতাকে যেন কাদতে হয়।” বালকটিকে এইভাবে অভিসম্পাত করে তিনি এগিয়ে চললেন।
    কিন্তু কয়েক মিনিট পর বালকটির মৃত্যু হল। যখন বন্ধুরা দেখল যে বালকটি প্রাণ ত্যাগ করছে, তখন তারা তার পিতামাতার কাছে গিয়ে সবকিছু বলল। যখন তার পিতামাতা সেই স্থানে এল, তখন দেখল রঘু বেহেরার অভিশাপে তাদের পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। তারা শিশুর মৃত্যু দেহকে তুলে নিয়ে রঘু বেহারার কাছে গেল এবং তার চরণে শুইয়ে রেখে তাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করল,“হে সাধু,তুমি যেহেতু সাধু তাই তুমি সকল জীবের সহৃদ, তুমি কেন আমাদের পুত্রদের শাস্তি দিয়েছ? যদি আমাদের ছেলে তোমার কাছে কোনো অপরাধ করে থাকে তার জন্য আমাদের শাস্তি হোক। আমাদের কেবল এই হচ্ছে একমাত্র পুত্র, দয়া করে আমার পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দাও!” তারা রঘু বেহারা চরণে পতিত হলো। তিনি তাদেরকে বললেন,“আমার যদি কোন দোষ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে শাস্তি দিন। এই বালকটির কিছু ঘটে থাকে তা ভগবানের ইচ্ছায় হয়েছে। তার অপরাধমূলক স্বভাবের জন্য ভাবগ্রাহী প্রভু তাকে দন্ডদান করেছেন। তার জীবন ফিরিয়ে দেবার আমি কে? প্রভু যদি চান যে এই বালকটি বেচে থাক তাহলে প্রভুর ইচ্ছাই পূরণ হবে। আপনারা ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করুন এবং আপনাদের পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেবার জন্য তার কাছে প্রার্থনা করুন।”
    রঘুর উপদেশ অনুসারে সকলেই ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করতে লাগল। এক সময় বালক যেন গভীর নিদ্রা থেকে জেগে উঠল। সেই বালক ও তার পিতামাতা সকলেই রঘু বেহারার চরণে পতিত হলো এবং তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন। প্রত্যেকই এই অলৌকিক ঘটনা দেখে বিস্মত হল এবং রঘুকে মহান সাধু ভেবে তার চরণপূজা করতে লাগল। তার পরে তারা নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেল। রঘু তার নিজ গৃহে ফিরে গেলেন এবং শ্রীগোবিন্দের দিব্যনাম জপরুপ ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হলেন। তার পর তিনি সুখে জীবন কাটাতে লাগলেন।
    একদিন তিনিঅত্যন্ত প্রীতি সহকারে খাদ্য প্রস্তুত করে ভগবানকে নিবেদন করার জন্য তার ধ্যানে বসলেন। তৎক্ষণাৎ প্রভু জগন্নাথ উপলব্ধি করলেন। যে তার ভক্ত তাকে ভোগ নিবেদন অভিলাষ করছে। রঘুর গভীর ভক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে প্রভু জগন্নাথ রঘুর সামনে আবিভুত হলেন। প্রেমানন্দে রঘু প্রভুকে একটি সুখময় আসন প্রদান করলেন এবং স্বহস্তে তাকে ভোজন করাতে লাগলেন, নিজ হস্তে তিনি খাদ্য তুলে দিতে লাগলেন, জগন্নাথদেব তার ভক্তের হাত থেকে ভোজন করার আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন।
    ঠিক সেই সময় রাজা মন্দিরে প্রভু জগন্নাথদেবকে বহু ধরনের খাদ্য সামগ্রী নিবেদন করলেন। পুরীমন্দিরে যখন পূজারী ভগবানকে খাদ্য ভজন করেন তখন তার হাতের তালুতে কিছু জল ধারণ করে রাখেন। প্রভু ভোগ গ্রহণ করেছেন কিনা নিশ্চিত হয় যখন পূজারীর হাতের তালুতে থাকা জলে প্রভুর প্রতিবিম্ব দেখা যায়। একে বলা হয় চলু। সেই দিন পূজারী রাজার প্রেরিত খাদ্য সামগ্রী যখন জগন্নাথদেব নিবেদন করছিলেন, তখন তার জলে প্রভুর কোন প্রতিবিম্ব দেখতে পেলেন না। তখন তিনি রাজাকে একথা জানালেন।। রাজা এই কথা জানার পর খুবই বিচলিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মন্দিরে এলেন এবং গরুড় স্তম্ভের পিছনে একটি কুশাসনে শয়ন করলেন। শ্রীজগন্নাথদেব রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন এবং বললেন,“কেন তুমি এত দুঃখিত হচ্ছ? আমি এখন পিপলি গ্রামে রঘু নামক জেলের গৃহে ভোজন করছি, সেই জন্য পূজারীর তালুতে আমার প্রতিবিম্ব পড়েনি। যখন আমার ভক্ত রঘু আমাকে ছারবে, তখন আমি তোমার মন্দিরে এসে খাদ্যসামগ্রী ভোজন করব। আমার ভক্তের মনোভাবই আমার কাছে সব কিছু। এইসব মূল্যবান খাদ্য সামগ্রীর উপর আমার কোন অনুরাগ নেই। তুমি পিপুলি গ্রাম থেকে আমার ওই ভক্ত রঘুবেহারাকে নিয়ে এস এবং তাকে এই পুরিধামে স্থান দাও। তখন আমি তোমার দ্বারা নিবেদিত খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ করব। বিলম্ব কোরো না।”
    তখন রাজার স্বপ্ন শ্রীজগন্নাথদেব অন্তর্হিত হলেন। রাজা তখন জেগে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ তিনি ঘোড়ায় চেপে পিপলি গ্রামের উদেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি রঘু বেহারার গৃহদ্বারে পৌছালেন এবং তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। কিন্ত সেই সময় রঘু বেহারা ভগবান জগন্নাথদেবের ভোগ নিবেদনে রত ছিলেন, তাই তিনি রাজার কোনো ডাকে সারা দিচ্ছিলেন না। তখন রাজা রঘু বেহারার গৃহের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং তার প্রবেশ করা মাত্রই শ্রীজগন্নাথদেব তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হতে অর্ন্তধান করলেন। শ্রীজগন্নাথদেবকে না দেখতে পেয়ে রঘু হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি ক্রন্দন করতে শুরু করলেন এবং ভুমিতে পতিত হয়ে শ্রীজগন্নাথদেবকে বলতে লাগলেন,“হে প্রভু! তুমি কোথায় চলে গেলে?” রাজা তখন দেখলেন সেখানে কী ঘটছে এবং তিনি রঘুকে ভুমি থেকে তুলে তাকে আলিঙ্গন করলেন। তিনি রঘুকে বললেন,“হে রঘু,তুমি ধন্য,তুমি ভগবানের আর্শিবাদ প্রাপ্ত হয়েছে। তুমি তোমার প্রেম ও ভক্তি দ্বারা ভগবান শ্রীহরিকে বশীভূত করেছো। এখন আমি তোমার পবিত্র দর্শনের দ্বারা উদ্বার লাভ করলাম।” রাজা তখন রঘুর হাত ধরলেন এবং তাকে সপরিবারে একটি সুসজ্জিত হাতির পিঠে চাপিয়ে তাকে সসন্মানে পুরীধামে নিয়ে এলেন। তারা প্রত্যেকেই শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শনের উদেশ্যে মন্দিরে এলেন। তখন শ্রীজগন্নাথদেবের ভোগ নিবেদন সার্থক হল। রাজা মন্দিরের দক্ষিণ প্রাপ্তে রঘুর জন্য একটি কুটির নির্ণাম করলেন এবং প্রতিপালনেরন দায়িত্ব নিলেন। রঘু বেহারা আনন্দের সঙ্গে ভগবান জগন্নাথদেবের সেবায় নিরত হলেন।

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    “জগন্নাথ স্নানযাত্রা মহোৎসব-

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “”♥ পর্ব -৩৭ ♥””

    আজকের লীলাঃ রহস্যময় জগন্নাথ পুরীধাম-

    ## রহস্যময় জগন্নাথ পুরীধাম-

    হরে কৃষ্ণ ভক্তবৃন্দ আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি রহস্যময় জগন্নাথ পুরীধামের কিছু তথ্য_যা আপনাকে সত্যি অবাক করবে-

    ১) আমরা জানি পুরীতে জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা দেবীর জন্য ৩টি রথ। কিন্তু শুনে অবাক হবেন যে, একসময় পুরীতে রথযাত্রার সময় ৬টি রথ ব্যবহৃত হত। প্রথম দিকে পুরীর মন্দির এবং মাসীবাড়ী (গুন্ডিচা মন্দির) মধ্যবর্তী স্থানে একটি নদী প্রবাহিত হত। তাই নদীর এই পারে ৩টি রথ এবং ঐ পারে ৩টি রথ ব্যবহৃত হত, এই পারের মন্দির থেকে নদী পর্যন্ত এবং ঐ পারের নদী থেকে মাসীমা মন্দির পর্যন্ত রথগুলো ব্যবহৃত হত । মাঝখানে নদী পারাপারের জন্য একটি বিশাল নৌকা ব্যবহৃত হত যাতে ভগবান জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ থাকত ।

    ২) জগন্নাথ মন্দিরের একসময়কার বিখ্যাত ভজন গায়কের নাম ছিল মোহাম্মদ আজিজ। তিনি ভগবান জগন্নাথদেবকে সুমধুর ভজন শোনানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

    ৩) যীশুখ্রীষ্ট ভগবান জগন্নাথদেবকে অলক্ষ্যে দর্শন করার জন্য পুরী ভ্রমণ করেছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভিতরে মূল মন্দিরের পেছন দিকে একটি বিশাল আকৃতির ক্রুস অভিষিক্ত রয়েছে।

    ৪) ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, ভগবান জগন্নাথদেব ও ভগবান বুদ্ধদেবের মধ্যেও এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। এমনকি পুরীতে ভগবান বুদ্ধদেবের অনেক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। অপরদিকে শিখদের ধর্মীয় গুরু নানকের কাছেও জগন্নাথদেব প্রিয় ছলেন।

    ৫) মন্দিরে ভগবানকে সর্বোচ্চ ৫৬ প্রকার ভোগ নিবেদন করা হয় তা অনেকেরেই জানা। কিন্তু এটি হয়ত অজানা যে জগন্নাথকে কোন বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সময় প্রতিদিন ৮৮ প্রকার ভোগ নিবেদন করা হয় এবং বিশেষ বড় বড় উৎসবের সময় এর চেয়েও বেশি ভোগ ভগবানকে নিবেদন করা হয়।

    ৬) শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে যে ভোগমণ্ডপটি রয়েছে এটি প্রকৃতপক্ষে কর্ণাটক মন্দিরের অংশ, যেটি ১৮ শতাব্দীতে মারাঠা কর্তৃক মন্দিরটির কিছু অংশ ধ্বংস হয়েছিল পরবর্তীতে তার কিছু অংশ পুরী মন্দিরের ভোগমণ্ডপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

    ৭) ‘অবধা’ অর্থাৎ ভগবান জগন্নাথদেবের অদ্ভুদ প্রসাদের নাম যে কেউ তৈরি করে না। নিজে নিজেই এই সুস্বাদু-কৃষ্ণ প্রসাদ তৈরি হয়। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য যে, বিশাল আকৃতির চুল্লীতে একটির পর একটি বসানো মাটির তৈরি পাত্রে সব উপাদান দিয়ে বসিয়ে দিলে সবচেয়ে উপরের পাত্রটি প্রথমে তৈরি হয়ে যায়। অথচ প্রথা অনুযায়ী বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে নিচের পাত্রটিই আগুনের তাপে প্রথম তৈরি হওয়ার কথা। যা পুরী মন্দিরের অবিশ্বাস্য এক প্রাত্যাহিক ঘটনা। বলা হয় যে, এ প্রসাদগুলো স্বয়ং মহালক্ষ্মী রান্না করেন।

    ৮) অনেকেই হয়ত জানেন জগন্নাথ পুরীর মন্দিরটি পুরাটাই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন তৈরি করেছেন। আসল সত্য এটাই যে, প্রকৃতপক্ষে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন শুধু মূল মন্দিরটিই তৈরি করেছিলেন। পুরীর বাকি যেসব অবকাঠামো রয়েছে যেমন মেঘানন্দ পাচেরী, মুখ্য শালা, নাটমন্ডপ এবং অন্যান্য অবকাঠামো বা মন্দিরগুলো তৈরি করেছিল সময়ের আবর্তনে আগত বিভিন্ন রাজা এবং শাসকরা।

    ৯) গর্ভ মুর, হল পুরী মন্দিরের সবচেয়ে অদ্ভুদ অংশ যেখানে ভগবানের সবরকমের মূল্যবান অলংকারসমূহ সংরক্ষণ রাখা হয়। এগুলো রক্ষনাবেক্ষনের জন্য যারা নিয়োজিত তারা হল কতগুলো বিষধর অদ্ভূত সাপ এবং স্বর্গীয় আত্মা।

    ১০) অপরদিকে রত্ন মুর নামে মন্দিরে উপরের অংশটিতে একটি অদ্ভূত বৃহৎ চুম্বক শক্তি রয়েছে। যেটি মন্দিরকে ঝড়ো বা প্রবল দমকা হাওয়ার স্থির রাখতে বা কোন ধ্বংস হওয়া থেকে অদ্ভূতভাবে সুরক্ষা করে। বলা হয়ে থাকে যে, মাঝে মাঝে ঐ অংশে তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যা সত্যিই অদ্ভূত।

    ১১) আপনি কি জানেন, রথযাত্রার সময় জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা দেবী যখন রথে আরোহন করে তখন সুদর্শন কোথায় অবস্থান করেন? অনেকেই বলবে জগন্নাথদেবের পাশে কিন্তু অদ্ভূত হলেও সত্য সুদর্শন জগন্নাথের পাশে না বরঞ্চ সুভদ্রা দেবীর পাশে অবস্থান করেন। তখন জগন্নাথের পাশে ‘মদনমোহন’ বিগ্রহ এবং বলদেবের দু’পাশে ‘রামচন্দ্র’ এবং ‘কৃষ্ণ’ এ দুটি পিতলের বিগ্রহ অবস্থান করেন।

    ১২) জগন্নাথের সম্মুখে নৃত্য প্রদর্শনের জন্য একদল সেবিকা রয়েছে যাদেরকে দেবদাসী নামে অভিহিত করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এসব সেবিকারদের ৯ বছর বয়সেই বিয়ে হয় স্বয়ং জগন্নাথের বিগ্রহের সঙ্গে। এরা নিজেদেরকে ভগবানের কাছে উৎসর্গ করে শুধুমাত্র এ নির্দিষ্ট সেবা নৃত্য প্রদর্শন করে। এ প্রথা স্বয়ং জগন্নাথদেবেরই নির্দেশে প্রচলিত। এক্ষেত্রে এর পিছনে একটি প্রাচীন সুন্দর কাহিনী রয়েছে। প্রতিদিন এসব দেবদাসী কিছু বিশেষ বিশেষ সময়ে ভগবানের সামনে তাদের নৃত্য প্রদর্শন করে থাকে । নৃত্য প্রদর্শনের সময় তারা দর্শকদের দিকে তাকাবে না। তাদের সকল মনোযোগ ভগবানকে কেন্দ্র করে। তাদের জন্য পুরুষ সঙ্গ নিষিদ্ধ।

    এভাবে যুগে যুগে জগন্নাথ পুরী সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিস্ময়ের এবং অদ্ভূত স্থান হিসেবে এই পৃথিবীতে অবস্থান করছে। এখনো মানুষ অবাক বিস্ময় জগন্নাথ এবং জগন্নাথ পুরীর অদ্ভূত সব কার্যকলাপের কথা শ্রবণ করে এবং স্বচক্ষে দর্শনের অভিলাষ করে। জয় জগন্নাথ

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    ♦জগন্নাথ ও শরণাগত জেলে-♦

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩৬ “”

    আজকের লীলাঃ “”জগন্নাথ ভজন””- ও মার্বেল চোর

    ## জগন্নাথ ভজনঃ-
    জয় জয় জগন্নাথ শচীর নন্দন,
    ত্রীভুবনে করে যার চরণ বন্দন।
    নীলাচলে শঙ্খ, চক্র গদা পদ্ম ধর,
    নদীয়া নগরে দন্ড কমন্ডলু পর।
    কেহ বলে পুরবে রাবন বদিলা,
    গোলকের বৈধ লীলা প্রকাশ করিলা।
    শ্রী রাধার ভাবে এবে গৌরা অবতার,
    হরে কৃষ্ণ নাম গৌরা করিল প্রচার।
    বাসুদেব ঘোষ বলে করি জোড় হাত,
    আমার যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ।
    জয় জয় জগন্নাথ শচীর নন্দন,
    ত্রিভুবনে করে যার চরণ বন্দন।
    জয় জগন্নাথ!

    জগন্নাথ দেবের অদ্ভুত লীলা কাহিনী –

    (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

    ## মার্বেল চোর_

    শ্রীধাম মায়াপুরের নিকটতম রাজাপুর জগন্নাথ নতুন মন্দিরটি নির্মানের সময় দিনের শেষে
    রাজমিস্ত্রী প্রতিদিন একটি মার্বেল পাথরের স্ল্যাব বাড়ী নিয়ে যেত। এভাবে কিছুদিন যাবার পর একদিন রাত্রে বলদেব স্বয়ং তার কাছে আবির্ভুত হলেন এবং ক্রোধে তাকে বললেন, “কেমন করে তোর এত সাহস হল যে তুই জগন্নাথের মন্দির নির্মানের পাথর চুুরি করিস। সব পাথর ফিরিয়ে দিয়ে আসবি, না হলে তোকে ও তোর পরিবারের সবাইকে আমি শেষ করে দিব“ সুতরাং পরদিন সেই মিস্ত্রী ভীত ও লজ্জিত ভাবে গরুর গাড়ী বোঝাই করে সব পাথর মন্দিরে ফিরিয়ে দিয়ে এল এবং জগন্নাথের কাছে ক্ষমা পার্থনা করলো

    চলবে————

    আগামী পর্বে থাকছে
    রহস্যময় জগন্নাথ পুরীধাম

    শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা- “” পর্ব -৩৫ “

    আজকের লীলাঃ “লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী”

    ## লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী-

    অগ্রহায়ণ মাসে উড়িষ্যার অধিবাসীগণ লক্ষ্মীদেবীর বিশেষ পূজা করে থাকেন। এই মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার গৃহের মহিলারা বিবিধ নিয়ম-রীতি ও উপচার সহকারে সাড়ম্বরে লক্ষ্মীদেবীর পূজার আয়োজন করে থাকেন। ঐদিন লক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথের অনুমতিক্রমে মন্দির থেকে বাইরে আসেন তাঁর ভক্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
    একবার এক শুভ বৃহস্পতিবারের সকালে এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবী বিভিন্ন গৃহ পরিদর্শন করতে গেলেন। এক বণিক-গৃহে গিয়ে দেখলেন, তাঁরা তখনও শয্যাত্যাগ করে নি, সেজন্য তাঁদের বাড়ীঘরও পরিষ্কার করা হয় নি। তিনি ঐ গৃহের এক মহিলাকে ঐ বিশেষ দিনে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করার গুরুত্ব বোঝালেন। কিন্তু ঐ বৃদ্ধা লক্ষ্মীদেবীর কথায় কর্ণপাত না করায় তিনি তাঁদের গৃহ থেকে সকল ঐশ্বর্য অপহরণ করলেন এবং ক্রমশঃ ঐ পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়ল এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহন করল।
    তারপর লক্ষ্মীদেবী একটি গ্রামে গেলেন যেখানে চণ্ডালেরা থাকে। তিনি শ্রীয়া চণ্ডালিনীর গৃহে গেলেন। তিনি ঐদিন ব্রত পালন করতঃ খুব ভোরে উঠে সমস্ত গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে লক্ষ্মীদেবীর পূজার উদ্দেশ্যে আল্পনাদি দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন। এসব দেখে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে আরও ধন ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ করে সকল মনস্কামনা পূর্ণ করলেন।
    ইতিমধ্যে শ্রীজগন্নাথ ও বলদেব প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে লক্ষ্মীদেবীকে চণ্ডালের গৃহ থেকে প্রত্যাবর্তন করতে দেখলেন। এতে বলদেব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে জগন্নাথকে কঠোর ভাষায় বললেন – “তোমার স্ত্রী আজকাল চণ্ডালের গৃহে যাচ্ছে। তারা অপবিত্র, সদাচারহীন – কোনো বিধিনিয়ম পালন করে না। কিভাবে এমন চণ্ডালের গৃহে যাবার পর ইনি আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন? আমাদের মন্দির অপবিত্র হয়ে যাবে। তোমাকে অবশ্যই তাঁকে পরিত্যাগ করতে হবে।” জগন্নাথ বলদেবকে এই বলে শান্ত করার চেষ্টা করলেন যে লক্ষ্মীদেবীকে এইবার মার্জনা করা হোক এবং আর কখনও এমন না করার জন্য বলা হোক। কিন্তু বলরাম তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন যে তাঁকে আর মন্দিরে প্রবেশের অনুমোদন দেয়া হবে না। “তুমি যদি লক্ষ্মীদেবীকে প্রবেশের অনুমতি দাও, তাহলে তোমার আমাকে ছাড়তে হবে। আমি মন্দিরের বাইরে অবস্থান করব।” যেহেতু জগন্নাথের অগ্রজ ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত বাধ্য, সেজন্য তিনি শ্রীবলরামের আজ্ঞা পালন করে লক্ষ্মীদেবীকে ডেকে বললেন যে তাঁর মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই।
    জগন্নাথের নিকট হতে একথা শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। বিবাহের সময় শ্রীজগন্নাথ তাঁর পিতার এই কথায় সম্মত হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর স্ত্রী-কৃত দশটি অপরাধ ক্ষমা করবেন। অধিকন্তু, তাঁর এই গ্রাম পরিদর্শন অপরাধমূলক ছিল না, কেননা সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়েছিল যে মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ) মাসের বৃহস্পতিবার তিনি তাঁর ভক্তদের আশিস দান করার জন্য গ্রামগুলি পরিদর্শন করতে বাইরে যেতে পারেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হল। এর ফলে তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিতা হলেন এবং জগন্নাথদেবকে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে আগামী ১২ বছর তিনি নিজেকে পরিতৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট আহার্য পাবেন না এবং তিনি কেবল লক্ষ্মীদেবীর রন্ধন করা ও পরিবেশন করা খাদ্যদ্রব্য ভোজন করতে সমর্থ হবেন। জগন্নাথকে অভিশাপ দানের পর তিনি যখন তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ত্যাগ করলেন, তখন মন্দির ঐশ্বর্যশূণ্য, শ্রীহীন হয়ে উঠল। ভাণ্ডারঘর শূণ্য হল।
    পরদিন সকালে জগন্নাথ ও বলরাম প্রাত-রাশের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কিছুই এল না। বলরাম জগন্নাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের প্রাত-রাশের কি হল? এত বিলম্ব হচ্ছে কেন?” জগন্নাথ উত্তরে বললেন, “কোনও প্রাত-রাশ তৈরি করা হয় নি, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেজন্য রান্না করার কেউ নেই এখানে।” তখন বলরাম ও জগন্নাথ কিছু আহার্য প্রস্তুত করার জন্য রন্ধনশালায় প্রবেশ করলেন। মন্দির থেকে তাঁদের দেবীকে বরখাস্ত করায় ক্রোধান্বিতা হয়ে লক্ষ্মীদেবীর অনুচরগণ রন্ধনশালার সমস্ত উনুনগুলি ভেঙে দিয়ে গেছে। তারা দু’ভাই রান্নার কিছু উপকরণ সংগ্রহের জন্য ভাণ্ডাঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, ঘর শূণ্য, কিছুই নেই সেখানে, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল শ্রী-ঐশ্বর্য মন্দির থেকে অপসৃত করেছিলেন। সেই সময় দুই ভ্রাতা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। লক্ষ্মীদেবীর উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং ক্ষুধায় ক্লিষ্ট হয়ে, তাঁরা উভয়ে ভিক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে মনস্থ করলেন।
    আমাদের জানতে হবে যে যদিও ভগবানই সকল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং প্রত্যেকের পালনকারী, তবুও তিনি একজন সাধারণ ভিক্ষুকের মতো ভিক্ষা করতে যাওয়ার এই বিশেষ লীলাটি করেছিলেন তাঁর ভক্তের মহত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য। এইভাবে শ্রীজগন্নাথ ও শ্রীবলদেব দুজন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে গৃহে গৃহে ভিক্ষা করার জন্য নগরে গেলেন। লক্ষ্মীদেবী থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাঁদের উভয়কেই অত্যন্ত অশুভ দেখাচ্ছিল এবং সেজন্য কেউই তাঁদের ভিক্ষা দিচ্ছিল না।
    ইতিমধ্যে, লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে সূর্যদেব সূর্যের তাপ বৃদ্ধি করেছিলেন। দুই ভাইকেই অত্যন্ত উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে হাঁটতে হচ্ছিল। তাঁরা একটি সুন্দর পুষ্করিণী দেখতে পেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ হেতু কাছাকাছি আসামাত্র জল শুকিয়ে গেল। অবশেষে তাঁরা বৃক্ষের কচিপাতা ভক্ষণের উদ্দেশ্যে বৃক্ষের কাছে যাওয়া মাত্রই বৃক্ষের পত্ররাজি শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। উভয়েই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত, তাঁরা মন্দিরে এতই ঘন ঘন ভোজন করতেন যে একবার ভোজনের পর হাত ধোওয়া মাত্রই পরবর্তী ভোজনের সময় সমাগত হত। সেদিন সারাদিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁরা কিছুই ভোজন করতে পারলেন না।
    শীঘ্রই তাঁরা একটি মন্দিরে গেলেন যেখানে তখন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছিল। বহু মানুষ সেখান থেকে প্রসাদ নিয়ে গৃহে ফিরছিল। জগন্নাথ ও বলরাম প্রসাদসহ প্রত্যাগমনরত মহিলাদের একজনের কাছে গেলে দয়াবশতঃ তিনি তাঁদেরকে কিছু প্রসাদ দিতে সম্মত হলেন। তাঁর কাছে কিছু নিবেদন করা মুড়ি প্রসাদ ছিল, তিনি তাঁদেরকে যেই একমুঠো মুড়ি দিতে যাবেন, ঠিক তখনই লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে প্রবল দমকা বাতাস এসে সমস্ত মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেল। দুই ভাই কিছু আহার পাওয়ার এই সুযোগটিও হারালেন।
    পরিশেষে, কোথায় আহার্য পাওয়া যাবে এ সম্বন্ধে লোকদের জিজ্ঞেস করলে তাঁদের একজন তাঁদেরকে চণ্ডালদের গ্রামে যেতে বলল, সেখানে অত্যন্ত দানশীল একজন ব্যক্তি থাকেন। জগন্নাথ ও বলরাম সেই গৃহে গিয়ে কিছু আহার্য চাইলেন। গৃহস্থ তাঁদের ভোজন করাতে পারবেন জেনে অত্যন্ত প্রীত হলেন, কিন্তু বলরাম একজন চণ্ডালের রান্না করা আহার্য ভোজন করতে সম্মত হলেন না। বরং তিনি নিজেই রান্না করে আহার্য প্রস্তুত করবেন বলে গৃহস্থকে কিছু অরন্ধিত আহার্যদ্রব্য ও রান্নার সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে বললেন। একটি নতুন উনুন তৈরি করে দেওয়া হল এবং রান্নার জন্য নূতন কিছু মাটির পাত্র তাঁদের দেওয়া হল। জগন্নাথ রান্না শুরু করার জন্য প্রস্তুত হলেন – কিন্তু কিছুতেই উনুনে আগুন ধরাতে পারলেন না, আহার তৈরীর কথা তো বলাই বাহুল্য। বলরাম জগন্নাথকে তাঁর অপারদর্শিতার জন্য ভৎর্সনা করলেন এবং নিজে আহার্য প্রস্তুত করতে গেলেন। কিন্তু যখন বলরাম কাঠে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলেন, কাঠ কিছুতেই জ্বলল না, কেবল প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হতে লাগল। তাঁদের চোখ থেকে জল পড়তে লাগল,আর সকলেই কাশতে লাগল। তখন বলরাম ও জগন্নাথ গৃহপতিকে কিছু রান্নাকৃত খাবার আনতে বললে গৃহের পরিচারিকারা দুই ভাইকে আহার্য পরিবেশন করলেন। তাঁরা যখন ভোজন করেছিলেন, তখন তাঁরা সহমত হলেন যে ঐ খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু, বস্তুতঃ মন্দিরে পরিবেশিত আহার্যের মতোই সুস্বাদু, যেখানে লক্ষ্মীদেবী রান্না করেন। ভোজনের শেষে তাঁদের কিছু সুস্বাদু পিঠে পরিবেশন করা হল। সচরাচর মন্দিরে ভোজনের শেষে লক্ষ্মীদেবী তাঁদের বিশেষ পিঠে খেতে দিতেন। লক্ষ্মীদেবী অবশ্যই এই গৃহে বিরাজ করছেন – জগন্নাথ ও বলরাম ভাবলেন। অন্য কেউ কিভাবে জানতে পারবে যে তাঁরা ভোজনের শেষে বিশেষ পিঠে আহার করেন? জগন্নাথের অগ্রজ হওয়ায় বলরাম লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতেন না, কেননা তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী; উড়িষ্যায় এটাই রীতি। বলরাম জগন্নাথকে লক্ষ্মীদেবীর নিকটে গিয়ে মার্জনা চাইতে এবং হাত ধরে তাঁকে মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি লক্ষ্মীদেবীকে বলতে বললেন যে তাঁর ভক্তবৃন্দকে পরিদর্শন করতে মন্দিরের বাইরে যেতে আর কখনোই বাধা দেয়া হবে না আর তিনি যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারবেন, কেবল সর্বদা তাঁকে মন্দিরে ফিরে আসতে হবে।
    জগন্নাথের নিকট সবকিছু শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী পরিতৃপ্ত হলেন। তিনি জগন্নাথকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে জগন্নাথের প্রসাদ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উঁচু জাতি বা নিচু জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য করা হবে না। অদ্যাবধি জগন্নাথ মন্দিরে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলকে প্রসাদ পরিবেশন করা হয়। এখানে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডাল এক পাত্রে প্রসাদ ভোজন করতে পারেন।
    জয় জগন্নাথ! জয় বলদেব!!
    জয় শ্রীমতী লক্ষ্মীদেবী!!

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    জগন্নাথ ভজন- ও মার্বেল চোর

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩৪ “”

    আজকের লীলাঃ “”লাণ্ডিমাতার নিমপাতা বাটা-“”

    ## লাণ্ডিমাতার নিমপাতা বাটা-

    এক সময় শুরীধামে লাণ্ডিমাতা নামে একজন বৃদ্ধা থাকতেন, তিনি ছিলেন জগন্নাথদেবের এক অনুরক্ত ভক্ত। শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতি তার বিশেষ ভাব অন্তরে উদিত হয়েছিল, সেই ভাবভক্তির প্রভাবে প্রভুকে তিনি তার পুত্র বলে ভাবতেন। প্রতিদিন লাণ্ডিমাতা প্রভুর জন্য কিছু নিমপাতা বাটা নিয়ে আসতেন। তিনি মনে মনে ভাবতেন, শ্রীজগন্নাথ প্রতিদিন ষাট বার ভোজন করেন, যার মধ্যে থাকে ছাপ্পান্ন রকমের অন্ন ব্যাঞ্জন, কতরকমের মিষ্টি, কত রকমের ঘি। তিনি অবশ্যই এত ধরণের গুরুপাক, জমকালো খাবার দাবার ভোজন করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, এবং তার হয়তো কিছু পেটের সমস্যা হয়েছে। সেই জন্য যদি কিছু নিমপাতা বাটা খান তাহলে তার পক্ষে তা খুবই ভালো হবে। এইরকম মনোভাব নিয়ে লাণ্ডিমাতা প্রতিদিন মন্দিরে যেতেন তার পুত্রকে নিমপাতা বাটা খাওয়াতে। একদিন পাত্রটি হাতে নিয়ে লাণ্ডিমাতা মন্দির প্রবেশ দ্বারে পৌঁছালেন, কিন্তু মন্দির প্রবেশের আগেই কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী তাকে থামালো ও বলল, ও হে বৃদ্ধা! এই পাত্রে তুমি কি নিয়ে যাচ্ছো? লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, আমি আমার পুত্রের জন্য কিছু নিমপাতা বাটা নিয়ে যাচ্ছি। রক্ষী বলল, তোমার পুত্র কি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে? লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, আমার পুত্র রত্নসিংহাসনে বসে আছে, তার আখিঁ দুটি বিশাল সে আমার এই নিমপাতার তৈরী পদটি ভোজন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাকে ভিতরে যেতে দাও। রক্ষী রেগে গিয়ে তাকে বলল, তুমি কি বলছো? জগন্নাথ তোমার ছেলে? প্রভু জগন্নাথদেবকে কত ধরণের অন্নব্যাঞ্জন নিবেদন করা হয়। সেই সব ভোজন করে তিনি তৃপ্ত নন?
    তিনি কেবল তোমার ওই নিমপাতা বাটা ভোজনের জন্য অপেক্ষা করছেন? নিরাপত্তারক্ষী লাণ্ডিমাতাকে মন্দিরের মধ্যে যেতে দিলেন না। ভগ্নহৃদয়ে লাণ্ডিমাতা তার কুটীরে ফিরে এলেন। আমার ছেলে নিশ্চয়ই তার এই নিমপাতার জন্য অপেক্ষা করে আছে, এমন ভাবতে ভাবতে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন। শ্রীজগন্নাথদেব লাণ্ডিমাতার অন্তরের ভাব উপলদ্ধি করলেন এবং তার সঙ্গে বাৎসল্য রস উপভোগ করার জন্য তিনি সেই রাত্রে তার কুটীরে আবির্ভূত হলেন। হঠাৎই এক উজ্জল আলোকপ্রভায় লাণ্ডিমাতার ঘরটি ভরে উঠল এবং তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন যে তার প্রিয় পুত্র জগন্নাথ তার সমানে দাড়িঁয়ে আছে। তারঁ মুখটি যেনো শুষ্ক ও বিবাদ। জগন্নাথ বললেন, মা আজ কত রকমের মিষ্টদ্রব্য ভোজন করেছি। আমার পেটে কষ্ট হচ্ছে, তুমি কি আমাকে কিছু নিমপাতা বাটা দেবে? লাণ্ডিমাতা তাড়াতাড়ি উঠৈ পড়লেন এবং উত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই জগন্নাথদেব তার গৃহ হতে অন্তঃহিত হলেন। সেই রাতে প্রভু শ্রীজগন্নাথদেব পুরীর রাজার কাছে স্বপ্নে আর্বিভূত হলেন এবং তাকে বললেন, রাজা! লাণ্ডিমাতা আমাকে তার পুত্র হিসাবে প্রীতি করেন। তিনি আমার মা, আর প্রতিদিন তিনি আমার জন্য অত্যন্ত প্রীতিসহকারে নিমপাতা বাটা নিয়ে আসেন। তোমার নিরাপত্তারক্ষী তাকে প্রবেশেদ্বারে থামিয়েছে এবং তার হাত থেকে নিমপাতা বাটার পাত্রটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। তার তৈরী নিমাপাতা বাটা খেতে আমি খুবই ভালোবাসি। আগামীকাল খুব ভোরে অবশ্যই তুমি তার কাছে যাবে এবং তাকে বলবে, সে যেন আমাকে ভোজন করাবার জন্য নিমাপাতা বাটা নিয়ে আসে। পরদিন খুব ভোরে রাজা তার মন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত লাণ্ডিমাতার ছোট্ট ঘরে গেলেন। তার কুটিরে রাজাও তার মন্ত্রিদের সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত লাণ্ডিমাতার ছোট্ট ঘরে গেলেন। তার কুটিয়ে রাজা ও তার মন্ত্রিদের দেখে লাণ্ডিমাতা খুব অবাক হলেন। রাজা তাকে বললেন, হে মাতা ! মন্দিরের পাহারাদার রক্ষী আপনার প্রতি এক মহা অপরাধ করেছে। আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনার হাতে তৈরী নিমপাতা বাটা শ্রীজগন্নাথদেবের খুবই পছন্দ। আপনি শ্রীজগন্নাথদেবের একজন মহান ভক্ত এবং আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবতী যে তিনি আপনার বাৎসল্যপ্রীতির ভাবটি গ্রহণ করেছেন এবং আপনাকে তিনি নিজে মাতা জ্ঞান করেন। আজ থেকে আপনার কুটীরটি লাণ্ডিমাতা মঠ নামে প্রসিদ্ধ হবে। এই স্থানটি একটি পবিত্র তীর্থ হিসাবে বিবেচিত হবে। এই পৃথিবীতে আপনি যতদিন থাকবেন, প্রতিদিন আপনি শ্রীজগন্নাথদেবক
    ে নিমপাতা বাটা খাওয়াবেন। এমনকি আপনি দেহত্যাগ করার পরেও আপনার স্মৃতিতে শ্রীজগন্নাথদেবকে এই পদটি নিবেদন করা হবে। রাজার কাছ থেকে এমন প্রীতিপূর্ণ কথা শুনে লাণ্ডিমাতা তার সৌভাগ্যের কথা ভেবে খুবই আনন্দিত হলেন। এখনকার দিনে নিমপাতা বাটার পরিবর্তে জগন্নাথদেব ছাপ্পান্ন ব্যাঞ্জনপদ ভোজন করার পর তিতোভোগ নামে একটি পদ ভোজন করেন এবং তারপর মিঠিজল বা মিষ্টি জল পান করেন-

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী-

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩৩ “”

    আজকের লীলাঃ “”জগন্নাথ পুরীতে গীতা পাণ্ডা””

    ## জগন্নাথ পুরীতে গীতা পাণ্ডাঃ-
    বহু পূর্বে জগন্নাথ পুরীতে অর্জুন মিশ্র নামে একজন পাণ্ডা ছিলেন। প্রতিদিন তিনি সম্পূর্ণ
    ভগবদগীতা পাঠ করতেন। যেহেতু তিনি দীর্ঘ সময় গীতা অধ্যয়নে ব্যয় করতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর অটল নিষ্ঠা ছিল, সেজন্য স্থানীয় মানুষ
    তাঁকে গীতা পাণ্ডা বলে অভিহিত করত। তিনি শ্রীজগন্নাথের একজন মহান ভক্ত- তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত, শরণাগত। যা কিছু ঘটত,
    তাকে তিনি ভগবানের কৃপা, অনুগ্রহ হিসাবে গ্রহণ করতেন। কোনো কিছুই ‘গীতা পাণ্ডা’-কে প্রভাবিত করতে পারত না। অর্জুন মিশ্র ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র ব্রাহ্মণ, ভিক্ষা দ্বারা তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। একবার প্রায় এক সপ্তাহ
    ধরে পুরীতে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, ফলে গীতা পাণ্ডা ভিক্ষায় বেরহতে পারলেন না। তাঁর যা অল্প-স্বল্প সঞ্চিত খাদ্যশস্য ছিল, অচিরেই তা ফুরিয়ে গেল। তিনি ও তাঁর পরিবার উপবাস করতে বাধ্য হলেন, তবুও গীতা পাণ্ডা বিচলিত হলেন না। তিনি সুখে গীতা পাঠ করে দিন যাপন
    করতে লাগলেন। তাকে বাইরে যেতে হচ্ছে না ভেবে তিনি খুশী হতেন এবং এটাকে তিনি একটি উত্তম সুযোগ বলেই গ্রহণ করলেন, কেননা তিনি গীতাপাঠের জন্য অনেক সময় পাচ্ছিলেন।
    তাঁর স্ত্রী অবশ্য এতে তাঁর প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি তাঁকে ভর্ৎসনা করলেন, “তুমি যদি বাইরে গিয়ে অন্ন সংগ্রহ না কর তাহলে কি করে তোমার পরিবার জীবন রক্ষা করবে? আমাদের তিন সন্তান। তুমি যদি বাইরে গিয়ে কিছু সংগ্রহ
    করে না আনো, তাহলে তারা তো মারা যাবে।” কিন্তু গীতা পাণ্ডা ছিলেন অবিচলিত। তিনি ভগবদগীতা থেকে তাঁকে একটি শ্লোক দেখালেন।
    অনন্যাশ্চিন্তয়ন ্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
    তেষাং নিত্যাভিযুক্তান
    যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।
    “অনন্যচিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাঁরা আমার উপাসনা করেন, আমি তাঁদের সমস্ত অভাব পূরণ
    করি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি।”
    কিন্তু তাঁর স্বামীর এহেন আচরণে মিশ্র-
    গৃহিণীর রাগ আরো বাড়ল। কয়েক দিন তিনি প্রতীক্ষা করলেন, কিন্তু তাঁর পতিদেব কিছুই নিয়ে আসলেন না। কেবলই তিনি বলতে থাকলেন,
    “আমরা যদি কেবল ভগবানের উপর নির্ভর
    করি, তাহলে তিনি সবকিছুর তত্ত্বাবধান করবেন, স্বয়ং তিনিই বলেছেন।” কতদিন তাঁর
    এইভাবে প্রতীক্ষা করতে হবে মিশ্র-গৃহিণী ভেবে পাচ্ছিলেন না। ছেলেমেয়েরা আহার্যের অভাবে খুবই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। মিশ্রের স্ত্রী অত্যন্ত
    ক্রোধান্বিতা হলেন। তাঁর পতির হাত থেকে ভগবদগীতা নিয়ে তিনি ঐ শ্লোকটি যেখানে উদ্ধৃত করা হয়েছিল সেখানে বের করলেন এবং শ্লোকের উপর দিয়ে তিনটি রেখা টেনে শ্লোকটি কাটলেন। পরবর্তীতে ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে তিনিও
    তাঁর সন্তানেরা নিদ্রামগ্ন হলেন। মিশ্রও বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। কিছুক্ষণ পরই মিশ্রজীর স্ত্রী দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলেন।
    তিনি শয্যাত্যাগ করে দরজা খুললেন। দুজন
    অত্যন্ত সুন্দর বালক সেখানে দাঁড়িয়েছিল, আর
    তাঁরা তাঁদের সঙ্গে আহার্য প্রস্তুত করার জন্য বহুবিধ খাদ্যো উপকরণ বহন করে নিয়ে এসেছিল। ব্রাহ্মণী এই সুন্দর দুই বালককে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তাঁদের একজন ছিল শ্যামবর্ণ, অন্যজনের গায়ের রঙ ছিল দুগ্ধধবল। কৃষ্ণবর্ণ বালকটি ব্রাহ্মণীকে বলল, “দয়া করে এই খাদ্য সম্ভারগুলি নিন-গীতা পাণ্ডার
    কোন মিত্র এগুলি প্রেরণ করেছেন। অনুগ্রহ
    করে এগুলি রান্না করুন এবং পূর্ণ পরিতৃপ্তি সহকারে ভোজন করুন।” ব্রাহ্মণী এই অনুপম সুন্দর দুই বালককে দর্শন করে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং তিনি যখন বালকদ্বয়ের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করলেন, তখন তাঁর হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হল। তিনি তাঁদের প্রতি গভীর স্নেহ-প্রীতি অনুভব করলেন। তিনি তাঁদের আহার্য প্রস্তুত করা পর্যন্ত
    অপেক্ষা করতে ও তাঁদের ভোজন করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু বালকটি উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আপনি ও আপনার স্বামীর সাথে প্রসাদ গ্রহণের জন্য আমাদেরও প্রবল ইচ্ছা ছিল, কিন্তু
    আমার জিহ্বা কেটে দেওয়া হয়েছে, সেজন্য আমি কিছুই আহার করতে পারছি না।” একথা বলে বালক দুটি বিদায় নিল। গীতা পাণ্ডা, অর্জুন মিশ্রের স্ত্রী সমস্ত ভোজ্যদ্রব্যগুলি ঘরে রেখে তাঁদের সৌভাগ্যের কথা তাঁর স্বামীকে বলতে গেলেন। যখন গীতা পাণ্ডা এসে সমগ্র ঘর ভর্তি বহুবিধ খাদ্য উপকরণ দেখলেন, তখন তিনি তাঁর
    স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ঐ বালক দুটিকে ভোজন করিয়েছ? আশা করি তুমি তাঁদের এই দয়ার প্রতিদানে কিছু প্রসাদ তাঁদের
    ভোজন করিয়েছ?” তাঁর স্ত্রী উত্তর দিলেন, “আমি তাঁদেরকে প্রতীক্ষা করে কিছু ভোজন করতে বলেছিলাম, কিন্তু কৃষ্ণবর্ণ বালকটি বলল যে কেউ তাঁর জিহ্বায় তিনটি স্থান কেটে ক্ষত করে দিয়েছে, সেজন্য সে কিছু খেতে পারছে না।”
    অর্জুন? মিশ্র যখন একথা শুনলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে ঐ কৃষ্ণবালক ভগবান স্বয়ং ব্যতীত অন্য কেউ
    নয়। যেহেতু তাঁর স্ত্রী শ্লোকটি তিনবার কেটেছিলেন, সেজন্য ভগবানের শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া ঐ শব্দগুলির খণ্ডিত রূপ তাঁর জিহ্বায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। মিশ্রগৃহিণী উপলদ্ধি করতে পারলেন যে তিনি তাঁর অনন্যচিত্ত ভক্তদের প্রতিপালন করবেন বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটির সত্যতা প্রমাণ করতে তিনি তাঁর প্রিয় ভক্তের জন্য স্বয়ং ভোজ্যদ্রব্য বহন করে এনেছেন। অবিলম্বে ব্রাহ্মণ পাণ্ডা ও তাঁর স্ত্রী কৃপাপরায়ণ শ্রীজগন্নাথের নিকট ক্ষমা প্রার্থন করা এবং তাঁদের প্রতি তাঁর করুণা ও অনুগ্রহের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে জগন্নাথ মন্দিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁরা যখন ভগবানের বেদীর সামনে গেলেন, তাঁরা সবিস্ময়ে শ্রীজগন্নাথের অধরে তিনটি দাগ লক্ষ্য করলেন।
    জয় জগন্নাথদেব।

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    শ্রীজগন্নাথদেবের নিমপাতা বাটা-

    শ্রী জগন্নাথ লীলা, মহিমা- “” পর্ব -৩২ “”

    আজকের লীলাঃ জগন্নাথ নিজেই এসেছিলেন-

    # # জগন্নাথ নিজেই এসেছিলেন-
    শ্রীল প্রভুপাদ-
    একদিন মালতী ব্যস্তভাবে শ্রীল প্রভুপাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে তার থলি থেকে একটি ছোট্ট কাঠের মূর্তি শ্রীল প্রভুপাদের ডেস্কের উপর রেখে, জিজ্ঞাসা করল, “এটা কি, স্বামীজী?” শ্রীল প্রভুপাদ নীচু হয়ে বড় বড় চোখ, চ্যাপ্টা মাথা, হাস্যোজ্জ্বল তিন ইঞ্চি লম্বা কালো পুতুলটিকে দেখতে লাগলেন। পুতুলটির গঠন মোটাসোটা, তার হাত দুটি সামনের দিকে বেরিয়ে আছে, তার বক্ষঃস্থল হলুদ আর সবুজ রঙে সাধারণভাবে রঙ করা আর তাতে কোন পা দেখা যাচ্ছে না। শ্রীল প্রভুপাদ তৎক্ষণাৎ সেই ছোট্ট মূর্তিটিকে শ্রদ্ধা সহকারে মাথা নীচু করে করজোড়ে প্রণতি নিবেদন করলেন। আনন্দে তাঁর চোখ দুটি ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তিনি হেসে বললেন, “তুমি জগতের নাথ জগন্নাথকে নিয়ে এসেছ। ইনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।” শ্রীল প্রভুপাদ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠলেন, আর স্বামীজীকে এইভাবে আনন্দ দিতে পেরে মালতী এবং অন্যরা বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে মেঝের উপর বসে রইল। শ্রীল প্রভুপাদ তাদের বোঝালেন যে, এটি হচ্ছে শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ, শ্রীকৃষ্ণের একটি বিগ্রহ, যা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে পূজিত হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন যে, আরও দুটি শ্রীবিগ্রহ-তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম এবং ভগিনী সুভদ্রাসহ তিনি পূজিত হন। উত্তেজিতভাবে মালতী জানাল যে, কোস্ট প্লাস নামক বিদেশ থেকে রপ্তানি করা জিনিসের দোকানটিতে সে এই ছোট্ট জগন্নাথকে খুঁজে পেয়েছিল। সেখানে এই রকম আরও কয়েকটি মূর্তি সে দেখেছে এবং শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বলেছিলেন, তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে সেগুলি কিনে আনতে। মালতী তার স্বামী শ্যামসুন্দরকে সেই কথা জানিয়েছিল এবং তারা দু’জনে তৎক্ষণাৎ সেই মূর্তি দুটি কিনে আনবার জন্য সেখানে ছুটে গিয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণবর্ণ, হাস্যোজ্জ্বল জগন্নাথকে ডানদিকে রেখেছিলেন। লাল হাস্যোজ্জ্বল মুখ, চৌকো চোখ এবং হলুদ রঙের অবয়ব-বিশিষ্ট সব চাইতে ছোট্ট মূর্তি সুভদ্রাকে মাঝখানে রেখেছিলেন এবং সাদা গোল মাথা, লাল রংঙের চক্ষু বিশিষ্ট, হাস্যোজ্জ্বল, জগন্নাথের মতো হাত দুটি সামনের দিকে বের করা এবং নীল আর হলুদ অবয়ব-বিশিষ্ট বলরামকে বাঁদিকে সুভদ্রার পাশে রেখেছিলেন। তাঁর ডেস্কের উপর তাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেউ কাঠখোদাই-এর কাজ জানে কি না। শ্যামসুন্দর জানিয়েছিল যে, সে একজন ভাস্কর এবং শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বলেছিলেন, এই জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রার তিন ফুট উঁচু প্রতিকৃতি খোদাই করতে।
    শ্রীল প্রভুপাদ তাদের বলেছিলেন যে, দু’হাজার বছর আগে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক এক কৃষ্ণভক্ত রাজা ছিলেন। সূর্যগ্রহণের সময় শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর ভ্রাতা ও ভগিনীসহ কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন, সেই প্রকাশের বিগ্রহ মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন খুঁজছিলেন। রাজা যখন স্বর্গের কারিগর বিশ্বকর্মাকে সেই রূপের মূর্তি তৈরি করতে অনুরোধ করেন, তখন একটি শর্তে বিশ্বকর্মা রাজী হয়েছিলেন-তাঁর কাজের সময় কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারবে না। দরজা বন্ধ করে বিশ্বকর্মা যখন কাজ করছিলেন, তখন দীর্ঘকাল রাজা অপেক্ষা করে ছিলেন। কিন্তু একদিন রাজা আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি দরজা খুলে কতটা কাজ হয়েছে, তা দেখতে গেলেন। তাঁর শর্তানুসারে তিনটি অসম্পূর্ণ মূর্তি রেখে, বিশ্বকর্মা সেখানে থেকে চলে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রার এই বিস্ময়কর মূর্তিগুলি পেয়ে, রাজা আনন্দে অধীর হয়ে তাঁদের পূজা করতে মনস্থ করলেন। তিনি তাঁদের একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠি করলেন এবং আড়ম্বরে তাঁদের পূজা করতে শুরু করলেন।
    শ্রীল প্রভুপাদ বলতে লাগলেন যে, সেই সময় জগন্নাথদেবে সমগ্র ভারতবর্ষে পূজিত হচ্ছেন, বিশেষ করে উড়িষ্যার জগন্নাথপুরীতে, যেখানে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় মহা সমারোহে শোভাযাত্রা সহকারে তিনটি বৃহৎ রথে চড়ে জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা যখন যান, তখন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী তাঁদের প্রতি পূজা নিবেদনের উদ্দেশ্যে সেখানে সমবেত হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন তাঁর জীবনের শেষ আঠারো বছর জগন্নাথপুরীতে অতিবাহিত করেন, তখন তিনি প্রতি বছর এই রথযাত্রা মহোৎসবে আনন্দে মগ্ন হয়ে, জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহের সামনে র্কীতন এবং নৃত্য করতেন।
    শ্রীল প্রভু বলেছিলেন, জগন্নাথদেব যেহেতু তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে সান ফ্রান্সিসকোতে আবির্ভূত হয়েছেন, তখন তাদের কর্তব্য হচ্ছে গভীর নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সহকারে জগন্নাথদেবকে গ্রহণ করা এবং তাঁর আরাধনা করা। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন যে, শ্যামসুন্দর যদি জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ প্রকট করতে পারে, তা হলে তিনি সেই বিগ্রহগুলি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ভক্তরা বিগ্রহগুলির পূজা শুরু করতে পারবে। তিনি সান ফ্রান্সিসকোর নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘নব জগন্নাথপুরী’। তিনি গেয়েছিলেন, “এটি হচ্ছে জগন্নাথদেবের মন্ত্র-‘হে জগতের পতি শ্রীজগন্নাথদেব! দয়া করে আপনি আমার নয়নপথে গমন করুন, যাতে আমি আপনাকে দর্শন করতে পারি।’ তিনি যে এখানে প্রকট হতে মনস্থ করেছেন তা অত্যন্ত মঙ্গলজনক।”
    শ্যামসুন্দর তিনটি বড় বড় কাঠের গুঁড়ি নিয়ে এসেছিল এবং শ্রীল প্রভুপাদ একটি নক্শা করে দিয়েছিলেন এবং সেই সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন, ছোট মূর্তিগুলির মাপ অনুসারে শ্যামসুন্দর তার বাড়ির বারান্দায় সেই কাঠগুলি খোদাই করতে শুরু করেছিল। ইতিমধ্যে ভক্তরা কোস্ট প্লাস নামক দোকানটি থেকে জগন্নাথদেবের বাকি সমস্ত মূর্তিগুলি কিনে নিয়েছিল এবং ক্ষুদ্র জগন্নাথকে একটি গলার হারে ঝুলিয়ে পরাটা প্রচলিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, জগন্নাথদেব যেহেতু অত্যন্ত উদার এবং অধঃপতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত কৃপাময়, তাই ভক্তরা অচিরেই তাঁকে তাদের মন্দিরে পূজা করতে সমর্থ হবে। মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের পূজা করতে হলে কঠোর নিয়মকানুন এবং অতি উচ্চমানের সেবা প্রয়োজন, যা ভক্তরা এখনও অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু জগন্নাথথদেব এতই কৃপাময় যে, তাঁকে খুব সরল পদ্ধতিতে আরাধনা করা যায় (বিশেষভাবে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে), এমনকি ভক্তরা যদি অতি উন্নত পর্যায়ভুক্ত না-ও হয়। ক্রমশ, তারা যতই পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভ করছিল, স্বামীজী ততই আরও বেশি করে গভীর ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধি সহ বিগ্রহ পূজার বিশদ নিয়ম-পদ্ধতি তাদের নিকট উপস্থাপনা করতেন। সেদিন সন্ধ্যায় ভক্ত এবং হিপি অতিথিতে সেই ঘরটি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানকার পরিবেশটি শ্রদ্ধামিশ্রিতভাবে আনন্দোচ্ছল হয়ে উঠেছিল। সেটি ছিল একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। সদ্যনির্মিত শ্রীবিগ্রহগুলি পূজামঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং রেড়উডের তৈরী বেদিমঞ্চে হলদে চাঁদোয়ার নীচে উজ্জ্বল আলোতে উদ্ভাসি সেই শ্রীবিগহের দিকে সকলেই তাকিয়েছিল। শ্রীবিগ্রহগুলির পরনে কোন কাপড় বা অলঙ্কার ছিল না, কিন্তু তাঁদের উজ্জ্বল কালো, লাল, সাদা, সবুজ, হলুদ এবং নীল রঙ দিয়ে রাঙানো হয়েছিল। তাঁদের মুখমণ্ডল ছিল হাসোজ্জ্বল। তাঁদের সেই উচ্চ পূজামঞ্চে শ্রীল প্রভুপাদও তাঁদের দেখছিলেন।
    প্রভুপাদ তারপর শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান শুরু করতে চান। পারমার্থিক জীবনের জন্য যা প্রয়োজন, তা সবই এখানে রয়েছে-মন্দির, ভক্ত, গ্রন্থ, শ্রীবিগ্রহ, প্রসাদ। তিনি চেয়েছিলেন, এই সমস্ত অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা এর সদ্ব্যবহার করুক। তারা কেন পশুর মতো জীবন যাপন করতে থাকবে এবং পারমার্থিক জীবন সম্বন্ধে ‘কোন একটি কিছু’ বলে মনে করে একটি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করবে? তারা শ্রীকৃষ্ণের করুণা গ্রহণ করুক এবং তাদের জীবনকে যর্থাথভাবে সাফল্যমণ্ডিত করে সুখী হোক। আর সেজন্য শ্রীল প্রভুপাদ ছিলেন তাদের শ্রান্তিহীন সেবক।
    জয় জগন্নাথ –

    চলবে————
    আগামী পর্বে থাকছে
    পুরীধামে গীতা পাণ্ডা_